আদ জাতি, সামূদ জাতি, হুদ আঃ, সালেহ আঃ, উটনি, আদ ও সামূদের শাস্তি, ইসলামের ইতিহাস, কুরআনের কাহিনি, শিরক, অহংকার
অহংকার, অবাধ্যতা এবং পাপাচার কোনো জাতিকে টিকিয়ে রাখতে পারে না—বরং ধ্বংস করে দেয়। আর বিনয়, আনুগত্য ও সততা একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখে যুগের পর যুগ।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে পাওয়া যায় দুই প্রভাবশালী জাতির কথা—আদ ও সামূদ। তারা ছিল উন্নত সভ্যতার অধিকারী, শক্তিশালী, উচ্চদেহী ও বলবান। কিন্তু আল্লাহর নাফরমানি ও নবীদের অমান্য করার কারণে তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
এই দুই জাতির পতন আজকের পৃথিবীর মানুষের জন্যও গভীর শিক্ষা।
আদ জাতি: অহংকারে অন্ধ এক শক্তিশালী সভ্যতা
আদ জাতির অবস্থান
আদ জাতি বসবাস করত ইয়েমেনের কাছাকাছি আহকাফ অঞ্চলে। এটি বর্তমান ওমান, ইয়েমেন ও রুবুল খালি মরুভূমির সংযোগস্থলে অবস্থিত। তাদের রাজধানীর নাম ছিল ইরাম, যা ধারণা করা হয় বর্তমান উবার/শিসর অঞ্চলের ধ্বংসাবশেষ।
তাদের বৈশিষ্ট্য
- অস্বাভাবিকভাবে লম্বা, বলবান মানুষ (সূরা ফজর ৬–৮)
- বিশাল স্থাপত্যশিল্প ও স্তম্ভসমৃদ্ধ নগর (ইরাম)
- পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ
- কৃষি–বাণিজ্যে সমৃদ্ধ
- অন্য জাতির ওপর প্রভাবশালী ক্ষমতা
- অহংকারে বলত—“আমাদের চেয়ে শক্তিশালী কে আছে?” (সূরা ফুসসিলাত ১৫)
তাদের অপরাধ
- আল্লাহকে ছেড়ে মূর্তিপূজা (সূরা হূদ ৫০–৫১)
- নবী হুদ (আঃ)-কে উপহাস ও প্রতিরোধ
- দুর্বল মানুষের ওপর জুলুম
- কৃতজ্ঞতার অভাব
- নিজেদের শক্তিকে সর্বোচ্চ মনে করা
হুদ (আঃ)-এর প্রতি তাদের আচরণ
হুদ (আঃ) তাওহীদের দাওয়াত দিলে তারা তাঁকে—
- মিথ্যাবাদী
- পাগল
- বুদ্ধি বিকৃত
- সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেয়
তারা হুদ (আঃ)-কে এবং তাঁর অনুসারীদের ওপর খাদ্য ও পানির অবরোধ পর্যন্ত আরোপ করে।
আদ জাতির ধ্বংস
প্রথমে তিন বছর ভয়াবহ খরা নেমে আসে। একদিন আকাশে কালো মেঘ দেখে তারা আনন্দিত হয়—কিন্তু সেটি ছিল শাস্তির ঝড়।
- ঝড় স্থায়ী ছিল সাত রাত ও আট দিন
- মানুষগুলো খেজুরগাছের গুড়ির মতো উড়ে পড়ে (সূরা আল-হাক্কাহ ৬–৮)
- প্রাসাদ, স্তম্ভ, নগর সব বালির নিচে বিলীন হয়ে যায় (সূরা আল-আহকাফ ২৫)
হুদ (আঃ) ও তাঁর অনুসারী ছাড়া কেউ বাঁচেনি।
সামূদ জাতি: উটনি হত্যাই ডেকে আনল ধ্বংস
বসবাসের স্থান
সামূদ জাতি বসবাস করত হিজর/মাদায়েন সালেহ অঞ্চলে—যা মদীনা ও তাবুকের মাঝামাঝি। আজও সেখানে তাদের পাহাড় কাটা ঘর দেখা যায়।
তাদের বৈশিষ্ট্য
- পাহাড় কেটে দৃষ্টিনন্দন ঘরবাড়ি (সূরা আশ-শু’আরা ১৪৯)
- বলবান, সমৃদ্ধশালী, কৃষি–বাণিজ্যে উন্নত
- অহংকারে অন্ধ ও শিরকের প্রতি ঝুঁকে পড়া
সালেহ (আঃ)-এর সাথে আচরণ
সালেহ (আঃ)-এর দাওয়াত তারা উপহাস করে প্রত্যাখ্যান করে—
“তুমি তো আমাদের সম্মানিত ব্যক্তি ছিলে! এখন আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম থেকে ফিরিয়ে দিতে চাও?” (সূরা হুদ ৬২)
তারা তাঁকে পাগল ও মিথ্যাবাদী বলে গালি দেয়।
আল্লাহর উটনি: পরীক্ষা যেখানে তারা ব্যর্থ
তাদের কাছে প্রমাণ হিসেবে আল্লাহ পাঠান এক অলৌকিক উটনি।
সালেহ (আঃ) বলেন—
“এটি আল্লাহর উটনি। তাকে কষ্ট দিও না।” (সূরা আশ-শু’আরা ১৫৫)
কিন্তু তারা নির্দেশ অমান্য করে উটনিটিকে হত্যা করে—এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধ।
সামূদ জাতির ধ্বংস
উটনি হত্যার পর তারা সালেহ (আঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে, কিন্তু আল্লাহ তাঁদের রক্ষা করেন।
এরপর আসে শাস্তি—
- ভয়াবহ ভূমিকম্প
- বজ্রধ্বনি
- প্রচণ্ড শব্দে সবাই মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে (সূরা হুদ ৬৭)
শুধু সালেহ (আঃ) ও তাঁর মুমিন অনুসারীরা রক্ষা পান।
কুরআনের সতর্কবাণী
“আর আদ ও সামূদের কাহিনি তো তোমরা জানো। শয়তান তাদের কর্মকে তাদের কাছে শোভন করেছিল, ফলে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছিল।”
— সূরা আল-আনকাবুত
আমাদের জন্য শিক্ষা
আদ ও সামূদ জাতি ছিল—
- শক্তিশালী
- ধনী
- সভ্য
- উন্নত
কিন্তু তাদের অহংকার, শিরক, জুলুম ও নবীদের অমান্য—এই চারটি অপরাধ তাদের ধ্বংস করে দেয়।
আজকের পৃথিবীর জন্যও এটি সুস্পষ্ট শিক্ষা—
- অহংকার মানবজাতির জন্য ভয়ংকর
- শিরক ধ্বংস ডেকে আনে
- জুলুম কখনো টেকে না
- কৃতজ্ঞতা আল্লাহর অনুগ্রহ বাড়ায়
- ন্যায়পরায়ণতা জাতিকে রক্ষা করে
চলবে…
বই: মানব সভ্যতা—রক্তে লেখা ইতিহাস
লেখক: আবু নাঈম মু. শহীদুল্লাহ্
