আজকের পৃথিবীর প্রতিটি কোণে অশান্তি বিরাজ করছে। অ্যান্টার্কটিকা থেকে নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রিসমাস আইল্যান্ড-বিশ্বের ১৯৫টি দেশে আমরা যেদিকে তাকাই, সেখানেই সমস্যা ও অশান্তির ছাপ স্পষ্ট। নৈতিক অবক্ষয় ও স্বার্থপরতার কারণে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় অন্যায়, দুর্নীতি, প্রতারণা ও ঠকবাজি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, খনিজ সম্পদের দখল, জাতিগত ও ধর্মীয় বিভেদ এবং সর্বোপরি ক্ষমতার লড়াইয়ের ফলে স্নায়ুযুদ্ধ বা সামরিক সংঘাতে পুরো পৃথিবী অস্থির ও সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।
অন্যায়, অত্যাচার ও যুদ্ধের ভয়াবহতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার মানুষ যেমন ভীত ও ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি তথাকথিত শান্তিপূর্ণ দেশগুলোতেও নানাবিধ অস্থিরতা বিরাজ করছে। শাসকগোষ্ঠীর শোষণের শিকার সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত মৌলিক অধিকারের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে।
মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সময়ে নানা মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে। এসব মতবাদের চমকপ্রদ আদর্শ ও যৌক্তিকতার ভিত্তিতে বিপ্লবও সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দেখা গেছে, শাসকগোষ্ঠী জনগণকে হতাশ করেছে, মানুষ মৌলিক অধিকার ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যুগের পর যুগ মানুষ মরীচিকার পেছনে ছুটছে, কিন্তু প্রকৃত শান্তি পাচ্ছে না। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য এক ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা দিয়েছেন, যার নাম ইসলাম।
ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা নাম : মানুষ স্রষ্টার সৃষ্টি এবং আশরাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা জীব)। কিন্তু স্রষ্টার আইন বাদ দিয়ে মানুষ যখন নিজস্ব মতবাদ তৈরি করে, তখন তা কখনোই প্রকৃত শান্তি দিতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষী, যত আদর্শ ও বিপ্লবই আসুক না কেন, একসময় তা ব্যর্থ হয়ে বিস্মৃতির গহ্বরে তলিয়ে গেছে। কেবলমাত্র মহান আল্লাহর আইন অনুযায়ী পরিচালিত সমাজই প্রকৃত শান্তি ও সুবিচার নিশ্চিত করতে পারে।
পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন সায়্যিদুনা নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তাঁর খোলাফায়ে রাশেদীন। তাঁদের শাসনামলে ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিটি দিক সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়েছিল। সেই সময়কার ইসলামী খিলাফত আজও ইতিহাসে প্রশংসিত হয়ে আছে, কারণ তখন মানুষ আল্লাহর বিধানের আলোকে পরিচালিত হতো। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যাতে কোনো কিছুই অসম্পূর্ণ নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”
(সূরা মায়েদা: আয়াত ৩)
স্রষ্টার মনোনীত জীবনব্যবস্থা ইসলাম অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হলেই মানুষ তার প্রকৃত অধিকার ফিরে পাবে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু আজ মানুষ ইসলাম ছেড়ে নিজেদের তৈরি মতবাদের পেছনে ছুটছে, ফলে বিশ্বজুড়ে অশান্তি ও সংকট লেগেই আছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “যে কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করতে চাইবে, তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আলে ইমরান: আয়াত ৮৫)
বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি মানুষের পার্থিব জীবনের কল্যাণ, পরকালীন জীবনের সফলতা, সামাজিক জীবনের ভারসাম্য এবং রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ আবশ্যক।
আল্লাহ তায়ালা বলেন: “হে মুমিনগণ, তোমরা সম্পূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাকারা: আয়াত ২০৮)
মুমিনদের ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং দুনিয়ার মতবাদকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ না করতে আল্লাহ বহুবার সতর্ক করেছেন। ঈমানদারদের একমাত্র প্রভু হলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা। তিনি বলেন: “তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস করো আর কিছু অংশ অস্বীকার করো? যারা এ কাজ করে, তাদের জন্য দুনিয়ায় অপমানজনক শাস্তি রয়েছে এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠোরতম আজাবে নিক্ষিপ্ত হবে। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে অজানা নন।” (সূরা বাকারা: আয়াত ৮৫)
ইসলামের মৌলিক ভিত্তি হলো—ঈমান, সালাত, সওম, হজ ও যাকাত।
বর্তমান পৃথিবীর বেশীরভাগ মুসলমানই ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো জানা ও মানার ব্যাপারে উদাসীন। যার কারনে মুসলমানদের মধ্যে নানান বিভক্তি ও নানান মত দেখা যায়। অথচ ঈমানের ভিত্তিতে এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই এবং নিজেদের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক ও সম্প্রীতি তৈরী হওয়া কথা ছিল। আমরা সংক্ষেপে ইসলামের মুল স্তম্ভ সম্পর্কে জেনে নেই।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত:
১. ঈমান বা শাহাদাহ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ)
২. সালাত কায়েম করা
৩. যাকাত প্রদান করা
৪. রমজান মাসের রোজা রাখা
৫. হজ্জ আদায় করা।” (সহিহ বুখারি: ৮)
ঈমান :
ঈমান একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ বিশ্বাস, দৃঢ় প্রত্যয় বা নিশ্চিত গ্রহণ করা। ইসলামী পরিভাষায় ঈমান বলতে একজন মানুষ স্বীকৃতি দিবে যে- আমি ঈমান আনলাম আল্লাহ তা’আলার প্রতি, তাঁর ফেরেশতারগণের প্রতি, তাঁর কিতাব সমূহের প্রতি, তাঁর রাসূলগণের প্রতি, কিয়ামত দিবসের প্রতি, তাক্বদীরের (ভাল ও মন্দ আল্লাহ তা’য়ালারই হাতে) প্রতি, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হওয়ার প্রতি। (ঈমানে মুফাসসাল)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঈমানের গুরুত্ব সংক্রান্ত বহু আয়াত নাযিল করেছেন।আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন : রসূল তার রবের পক্ষ থেকে তার ওপর যে হিদায়াত নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে। আর যেসব লোক ঐ রসূলের প্রতি ঈমান এনেছে তারাও ঐ হিদায়াতকে মনে-প্রাণে স্বীকার করে নিয়েছে। তারা সবাই আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদেরকে, তাঁর কিতাবসমূহকে ও তাঁর রসূলদেরকে মানে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছেঃ “আমরা আল্লাহর রসূলদের একজনকে আর একজন থেকে আলাদা করি না। আমরা নির্দেশ শুনেছি ও অনুগত হয়েছি। হে প্রভু! আমরা তোমার কাছে গোনাহ মাফের জন্য প্রার্থনা করছি। আমাদের তোমারই দিকে ফিরে যেতে হবে। (আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ২৮৫)
হে ঈমানদারগণ! ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি, তাঁর রসূলের প্রতি, আল্লাহ তাঁর রসূলের ওপর যে কিতাব নাযিল করেছেন তার প্রতি এবং পূর্বে তিনি যে কিতাব নাযিল করেছেন তার প্রতি। যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাবর্গ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রসূলগণ ও পরকালের প্রতি কুফরী করলো সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহুদূর চলে গেলো। (আন-নিসা, আয়াত: ১৩৬)
এ থেকে বোঝা যায় যে ঈমান শুধু একটি মৌখিক উচ্চারণ নয়, বরং এটি হৃদয়ের গভীর বিশ্বাস এবং কর্মের সাথে সম্পর্কিত।
ঈমানেরও স্তম্ভ ও শাখা রয়েছে তা হচ্ছে : হযরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.)-এর কাছে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) এসে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন—”ঈমান হলো, তুমি বিশ্বাস করবে— ১. আল্লাহর প্রতি ২. তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি ৩. তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি ৪. তাঁর রাসূলগণের প্রতি ৫. পরকালের প্রতি ৬. ভালো-মন্দ তাকদীরের প্রতি” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ঈমানের প্রধান ছয়টি স্তম্ভ রয়েছে।
নবী (সা.) বলেন—”ঈমান হল ৭০-এর অধিক বা ৬০-এর অধিক শাখাবিশিষ্ট। এর মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা এবং সর্বনিম্ন স্তর হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। লজ্জাশীলতাও ঈমানের একটি অংশ।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯, সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৫)
এটি প্রমাণ করে যে ঈমান শুধুমাত্র অন্তরের বিশ্বাস নয়, বরং আমলের সাথেও গভীরভাবে সম্পর্কিত।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন : “ঈমান হল অন্তরের বিশ্বাস, জিহ্বার স্বীকৃতি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা তার বাস্তব প্রতিফলন।” (আল-ফিকহুল আকবর)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন :”ঈমান কেবল মুখে বলা নয়, বরং এটি অন্তরের বিশ্বাস, মুখের স্বীকারোক্তি এবং আমলের সমন্বয়ে পরিপূর্ণ হয়। এটি বাড়তেও পারে, কমতেও পারে।” (মাজমু’ আল-ফাতাওয়া, ৭/৫৮৭)
ইমাম নববী (রহ.)বলেন :”ঈমান শুধু অন্তরের ব্যাপার নয়, এটি মুখের স্বীকৃতি ও শরীরের কর্মেও প্রতিফলিত হয়।” (শরহে মুসলিম)
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের প্রথমটি হলো ঈমান । এটি শুধু মুখের স্বীকারোক্তি নয়, বরং হৃদয়ের গভীর বিশ্বাস, এবং সে বিশ্বাস অনুযায়ী কর্ম করার নাম।
সালাত:
সালাত বা নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ কোন মানুষ ঈমান আনার সাথে সাথেই সালাতের বিষয়ে তাাকিদ দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন :সালাত কায়েম করো, যাকাত দাও এবং যারা রুকু করার মধ্যে যারা রয়েছে, তাদের সাথে রুকু করো।” (সূরা আল-বাকারা: ৪৩)
যারা বিনয়ের সাথে সালাত আদায় করে তারা সফলতা লাভ করে। সুরা মু’মেনিনে আল্লাহ বলেন : নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মু’মিনরা, যারাঃ নিজেদের নামাযে বিনয়াবনত হয়।
আমরা নিজেদের ঈমানদার দাবী করে সফলতা লাভের শতভাগ আশা করি।কিন্তু আমরা সালাতের ব্যাপারে যথেষ্ট উদাসীন কেউ দুই ঈদের নামাজকে যথেষ্ট মনে করি, আবার কেউ সাপ্তাহে একদিন জুমার নামাজ আদায় করে নিজেদের ঈমানদার পরিচয় দেই।
অথচ আল্লাহ তা’য়ালা দৈনিক পাঁচবার নামাজ আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। যারা নামাজ আদায়ে গাফেলতি করে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন : তারপর এদের পর এমন নালায়েক লোকেরা এদের স্থলাভিষিক্ত হলো যারা নামায নষ্ট করলো এবং প্রবৃত্তির কামনার দাসত্ব করলো। তাই শীঘ্রই তারা গোমরাহীর পরিণামের মুখোমুখি হবে। (সূরা মারিয়াম: ৫৯)
এ কথা সুস্পষ্ট যে, সালাত পরিত্যাগ করি গোমরাহির দিকে ধাবিত হয়। আমরা দেখি কোন ব্যক্তি যখন নামাজ ছেড়ে দেয়। তখন সে অন্যান হারাম কাজ গুলোকে হারাম মনে করে না। বরং তার কাছে স্বভাবিক মনে হয়। এবং সে তার চিন্তাকে সঠিক প্রমানের জন্য যুক্তি খুজতে থাকে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “আমাদের ও তাদের (অবিশ্বাসীদের) মধ্যে পার্থক্যকারী বিষয় হলো সালাত। যে তা ছেড়ে দিল, সে কুফরি করল।” (তিরমিজি: ২৬২১)
এখান থেকে আমরা স্পষ্ট হলাম যে- সালাত ঈমান ও কুফরের মধ্যে প্রধান পার্থক্যকারী উপাদান।
ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেন: “সালাত এমন একটি ইবাদত যা মানুষের অন্তরকে শুদ্ধ করে এবং আত্মাকে আল্লাহর সাথে সংযুক্ত রাখে।”
শাইখ ইবনে উথাইমিন (রহ.) বলেন: “সালাতই একমাত্র ইবাদত যেখানে বান্দা আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলে এবং তাঁর নৈকট্য লাভ করে।”
ঈমানদার সালাত আদায় করার মাধ্যমে ঈমানের দৃঢ়তার প্রকাশ করে। আর সালাত মানুষকে মন্দ কাজ থেকে দুরে রাখে। আল্লাহ বলেন :তোমার প্রতি যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা থেকে তিলাওয়াত কর এবং সালাত কায়েম কর। নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন যা তোমরা কর। (সুরা আনকাবুত আয়াত ৪৫)
এটা শুধু একটি আনুষ্ঠানিক ইবাদত নয়, বরং এটি ইসলামের প্রাণ। যিনি নামাজ আদায় করেননা তার ঈমানদার বা মুসলিম পরিচয় দেওয়াটা হাস্যকর।
সাওম:
ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি কতটুকু আত্নসমর্পণ করেছে এবং কি রকম অনুগত হয়েছে তা প্রমাণিত হয় গোপন ইবাদতের মাধ্যমে। সাওম একধরনের গোপন এবাদত কারণ রোজা রাখা মানে শুধুমাত্র খাবার, পানি ও যৌন সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা নয়।বরং এটি মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য, এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যম। রোজাদার চাইলে মানুষের অজান্তে খাবার ও পানি গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু সে করেনা। কারন সে আল্লাহ ভয় করে এবং সে সাফল্য অর্জন করতে চায়।
সাফল্য বলতে আল্লাহর সন্তুষ্টির অর্জনের মধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং চির সুখের জান্নাত কামনা করা। যা ঈমানদারের একমাত্র লক্ষ্য।
আল্লাহ বলেন: “হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সূরা আল-বাকারা ২:১৮৩)
রোজার পালনের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজ নফসের খারাপ দিকগুলো দমন করে নিজকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করতে পারে। নবী (সা.) বলেছেন: “রোজা হলো একটি ঢাল, যা তোমাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবে।” (সহিহ বুখারি: ১৯০৪)।
রোজার পালনের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তি ক্ষুধার কষ্ট অনুভব করতে পারে, যা তাকে গরিবদের প্রতি দয়ালু করে তোলে। ফলে সমাজে সামাজিক ভারসাম্য ও সংহতি সৃষ্টি হয়।
রোজা ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে :রোজা মানুষের অভ্যন্তরীণ আত্মশুদ্ধি ঘটায়, যা সমাজকে অপরাধমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন:”যে ব্যক্তি রোজা রেখেও মিথ্যা কথা বলা এবং অন্যায় কাজ করা বন্ধ করেনি, তার শুধু না খেয়ে থাকার কোনো মূল্য নেই।” (সহিহ বুখারি: ১৯০৩)।
অর্থাৎ, প্রকৃত রোজা শুধু খাদ্য থেকে নয়, বরং সব ধরনের পাপ থেকে বিরত থাকার নাম। যদি সমাজের প্রতিটি মানুষ এই আদর্শ মেনে চলে, তবে সমাজ হবে সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও শান্তিপূর্ণ।
ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন: “রোজা শুধু খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকার নাম নয়; বরং চোখ, কান, জিহ্বা, মন ও শরীরকে সব ধরনের পাপ থেকে রক্ষা করার নামই প্রকৃত রোজা।”
ড. ইউসুফ আল-ক্বারদাওয়ি বলেন: “রোজা সমাজে সংহতি, সংযম এবং নৈতিকতার সংস্কৃতি গড়ে তোলে, যা সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”
ঈমানদারদের এটা সুস্পষ্ট ধারণা রাখা দরকার
রোজাকে ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ করা হয়েছে, জন্য যে এটি মানুষের আত্মশুদ্ধি, আল্লাহভীতি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সংহতি সৃষ্টি করে। ধনী ও গরিবের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, অপরাধ দমন এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই, রোজার মূল উদ্দেশ্য শুধু উপোস থাকা নয়, বরং একজন পরিপূর্ণ নৈতিক ও আত্মনিয়ন্ত্রিত মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা।
যাকাত:
যাকাত ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ, পবিত্র কুরআনে
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং যারা আমার সামনে অবনত হচ্ছে তাদের সাথে তোমরাও অবনত হও।(সুরা আল-বাকারাহ: ৪৩)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন :নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং রসূলের আনুগত্য করো, আশা করা যায়, তোমাদের প্রতি করুণা করা হবে। (সুরা আন-নূর: ৫৬)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নামাজের পর যাকাতের বিষয় বেশী উল্লেখ করেছেন।
প্রচলিত সমাজে বিত্তবানরা কিছু শাড়ি, লুঙ্গী ও খাবার বিতরণ করে যাকাত পরিশোধ করে থাকেন। বেশীর ভাগ যাকাতদাতার মনোভাব থাকে এমন যে তিনি করুনা করছেন। অথচ এটা আল্লাহর নির্দেশ, এটা গরিবের অধিকার।
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন: “যাকাত কেবল দানের একটি মাধ্যম নয়, এটি সমাজের দরিদ্র ও অভাবীদের অধিকার। ধনীরা এটি আদায় না করলে তারা গুনাহগার হবে এবং সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হবে।”
ইমাম গাযালি (রহ.) বলেন: “যাকাত ধনীদের অন্তরের লোভ-লালসা দূর করে এবং দরিদ্রদের মধ্যে সহানুভূতি সৃষ্টি করে। এটি মুসলিম উম্মাহর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম স্তম্ভ।”
অত্যান্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে অনেক সম্পদশালী ব্যক্তি সম্পদ কমে যাবে এ ধারণা করে যাকাত দান থেকে বিরত থাকেন। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত প্রদান করে না, কিয়ামতের দিন সেই সম্পদ বিষাক্ত সাপের রূপ ধারণ করবে এবং তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে।” — (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪০৩)
ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, “যারা যাকাত প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানাবে, আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।” — (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩৯৯)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,: হে নবী! তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদকা নিয়ে তাদেরকে পাক পবিত্র করো, (নেকীর পথে) তাদেরকে এগিয়ে দাও এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করো। তোমার দোয়া তাদের সান্তনার কারণ হবে। আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।
যাকাত ইসলামের একটি অপরিহার্য বিধান এবং যে ব্যাপারে গাফলতি করবে তার জন্য ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে।
হজ্জ :
ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হচ্ছে হজ্জ ,প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে একবার ফরজ করা হয়েছে।
হজ্জ সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ করা হয়েছে এবং এটি ইমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
পবিত্র হজ্জের সময় ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা, কালো-সাদা সবাই একত্র হয়ে এক আল্লাহর ইবাদত করে, যা ইসলামের সার্বজনীনতা প্রমাণ করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন: আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যখন হজ্ব ও উমরাহ করার নিয়ত করো তখন তা পূর্ণ করো। আর যদি কোথাও আটকা পড়ো তাহলে যে কুরবানী তোমাদের আয়ত্বাধীন হয় তাই আল্লাহর উদ্দেশ্যে পেশ করো। আর কুরবানী তার নিজের জায়গায় পৌঁছে না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা নিজেদের মাথা মুণ্ডন করো না। তবে যে ব্যক্তি রোগগ্রস্ত হয় অথবা যার মাথায় কোন কষ্ট থাকে এবং সেজন্য মাথা মুণ্ডন না করে তাহলে তার ‘ফিদিয়া’ হিসেবে রোযা রাখা বা সাদকা দেয়া অথবা কুরবানী করা উচিত। তারপর যদি তোমাদের নিরাপত্তা অর্জিত হয় (এবং তোমরা হজ্বের আগে মক্কায় পৌঁছে যাও) তাহলে তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি হজ্ব্বের সময় আসা পর্যন্ত উমরাহ্র সুযোগ লাভ করে সে যেন সামর্থ অনুযায়ী কুরবানী করে। আর যদি কুরবানীর যোগাড় না হয়, তাহলে হজ্ব্বের যামানায় তিনটি রোযা এবং সাতটি রোযা ঘরে ফিরে গিয়ে, এভাবে পুরো দশটি রোযা যেন রাখে। এই সুবিধে তাদের জন্য যাদের বাড়ী-ঘর মসজিদে হারামের কাছাকাছি নয়। আল্লাহর এ সমস্ত বিধানের বিরোধিতা করা থেকে দূরে থাকো এবং ভালোভাবে জেনে নাও আল্লাহ কঠিন শাস্তি প্রদানকারী।
ঈমানদারদের মধ্যে যাদের পবিত্র কাবা পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে তারা যেন হজ্জ পালন করে নেয়।
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : তার মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং ইব্রাহীমের ইবাদাতের স্থান। আর তার অবস্থা হচ্ছে এই যে, যে তার মধ্যে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। মানুষের মধ্য থেকে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন এই গৃহের হজ্ব সম্পন্ন করে, এটি তাদের ওপর আল্লাহর অধিকার। আর যে ব্যক্তি এ নির্দেশ মেনে চলতে অস্বীকার করে তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন।(আলে-ইমরান, আয়াত: ৯৭)
ঈমানদার ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য, তাকওয়া এবং বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের অন্যতম মাধ্যম পবিত্র হজ্জ।
রাসুল (সাঃ) বলেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ্জ করে এবং কোনো অশ্লীল কথা বা পাপ কাজে লিপ্ত না হয়, সে নবজাতকের মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে।” — (সহিহ বুখারি: ১৫২১, সহিহ মুসলিম: ১৩৫০)
হজ্জে সময়ে হজ্জের বিধান সমুহ পালন অনেকটা কষ্টকর। যারা দুনিয়ার লোভ পরিহার করে, অহংকার,ও আত্মগরিমা থেকে নিজেকে মুক্ত করে আল্লাহ প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে। তাদের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন নবী কারিম (সা:)তিনি বলেছেন: “একটি মাবরুর (শুদ্ধ) হজ্জের প্রতিদান একমাত্র জান্নাত।” — (সহিহ বুখারি: ১৭৭৩, সহিহ মুসলিম: ১৩৪৯)
মুসলিম উম্মাহ ঐক্যে প্রতিক পবিত্র হজ্জ সে সময় সকলে একই পোশাক ও একই রকম তালবিয়া পাঠে মগ্ন থাকে। আত্মশুদ্ধি,আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সবর এর দারুন এক শিক্ষা সফর হচ্ছে পবিত্র হজ্জ।
সামর্থ্যবান কেউ যদি হজ্জ না করেন তার ব্যাপারে
নবী (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি হজ আদায় করার সামর্থ্য রাখে, কিন্তু তা করে না, সে ইহুদি বা খ্রিস্টান হয়ে মরুক!” (তিরমিজি: ৮১২)
লেখক : আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্
সভাপতি: সিআরসিআইপিটি ( CRCIPT)