উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপে ইসলামের আগমন ও মুসলিম আমিরাত।অন্ধকারে নিমজ্জিত মানবজাতিকে আলোর সন্ধান দিতে যে কাফেলা বের হয়েছে নবী মুহাম্মাদ সাঃ এর নেতৃত্বে। সে কাফেলার সাথীরা মক্কা থেকে মদিনা হয়ে সিরিয়া, দামেস্ক থেকে খিলাফত পরিচালনা করে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন অর্ধ পৃথিবীর মানুষের কাছে।সমগ্র মানবজাতির নিকট ভিন্ন একটা পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করেন মুসলিম জাতি।
পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত সকল সভ্যতাকে পিছনে ফেলে যখন মুসলিম সভ্যতার জয়জয়কার অবস্থা ঠিক তখন আফ্রিকা ও ইউরোপের নির্যাতিত মানুষ ইসলামকে স্বাগত জানান। উমাইয়া খিলাফতকালে আব্দুল্লাহ ইবনে নাফি, মুসা ইবনে নুসাইর ও বীর সিপাহসালা তারিক বিন যিয়াদ এর দুর্দান্ত সাহস ও প্রান পন প্রচেষ্টায় এ অন্ঞ্চলে ইসলামের আগমন। দামেস্ক থেকে উমাইয়া খিলাফত পতনের পর প্রথম আব্দুর রহমান দামেস্ক থেকে স্পেনে এসে আমিরাত অব কর্ডোভা নামে শাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বৃহৎ মুসলিম খিলাফতের শাসনভার তখন আব্বাসীয়দের হাতে। ইউরোপের পূর্ব প্রতিষ্ঠিত আল আন্দলুসে প্রথম আব্দুর রহমানের আগমনে এ অন্ঞ্চলের মুসলমানগন তাকে স্বাগত জানাননি এবং সহজে আনুগত্য মেনে নেননি । মহাবীর তারিক বিন যিয়াদ এর ৭১১ সালে স্পেন বিজয়ের পর থেকে ৭৫৬ সালে প্রথম আব্দুর রহমান এর আগমন পর্যন্ত আল আন্দালুস মুসলিম খেলাফতের খলিফার আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হতো।
এক নজরে পশ্চিমান্ঞ্চলে মুসলিম শাসনামল ভৌগোলিক এলাকা গুলো সম্পর্কে ধারনা দেওয়া হলো-
আল আন্দালুস ৭১১-১৪৯২ সাল
আমিরাত অফ কর্ডোভা ৭৫৬-৯২৯ সাল
খিলাফত অব কর্ডোভা ৯২৯-১০৩১ সাল
ভলগা বুলগেরিয়া ৯২১-১২৪০ সাল
আমিরাত অব ক্রিট ৮২০-৯৬১ সাল
আমিরাত অব সিসিলি ৮৩১-১০৯১ সাল
ইমারাত অব বারি ৮৪৭-৮৭১ সাল
আমিরাত অব গ্রানাডা ১২৩০-১৪৯২ সাল
গোল্ডেন হোর্ড ১৩১৩-১৫০২ সাল
খাতানা অব খাজান ১৪৩৮-১৫৫২ সাল
ক্রিমিয়ান খানাতে ১৪৪১-১৭৮৩ সাল
আষ্ট্রখান খানাতে ১৪৬৬-১৫৫৬ সাল
ককেশাসিয়ান ইমামাত ১৮২৮-১৮৫৯ সাল
আইডেল উরাল ষ্টেট (মাত্র ২৭ দিন)১৯১৮ সাল
চেচেন রিপাবলিক অব ইস্কেরিয়া ১৯৯১-২০০০ সাল।
আল আন্দালুসঃ ভিসিগোথিক রাজ্যের রাজা রডেরিকের নির্যাতনের হাত থেকে জনগণকে বাঁচাতে মুসলিম সেনাপতি রীব তারিক বিন যিয়াদ ৭১১সালে যে অভিযান পরিচালনা করেন তাতে মুসলমানরা বিজিত হন। মুসলমানদের অধিকারে চলে আসে স্পেনের আন্দালুসিয়া, গেলেসিয়া,পর্তুগাল,কাস্টিল,লিওন,আরাগন,সেভিলা,সেপ্টেমেনিয়া। আইবেরিয়ান উপদ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এঅন্ঞ্চল গুলো নিয়ে গঠিত হয় আল আন্দালুস বা আন্দালুসিয়া।
রাজনৈতিক পরিচিতির দিক থেকে এটি যথাক্রমে উমাইয়া খিলাফতের প্রদেশ ৭১১-৭৫০ সাল পর্যন্ত এ খিলাফতের প্রথম গভর্নর হন আবদ আল-আজিজ ইবনে মুসা। তিনি রাজধানী হিসাবে সেভিলকে পছন্দ করেন। ৭১৭ সাল নাগাদ, উমাইয়ারা সেপ্টিমেনিয়াতে তাদের প্রথম অভিযান চালানোর জন্য গল আক্রমন করেন । ৭১৯ সালের মধ্যে, বার্সেলোনা এবং নারবোনও অধিকার করে। দামেস্ক উমাইয়া খিলাফত ধ্বংসের পরেও আন্দালুসিয়া উমাইয়াদের শাসন চালু ছিলো।
আমিরাত অব কর্ডোভাঃ আমিরাত অব কর্ডোভা ছিল ৭৫০-৯২৯ সাল পর্যন্ত, ৭৫৬ সালে প্রথম আব্দুর রহমান নিজেকে আমিরাতে গর্ভনর বা আমির ঘোষণা করেন তিনি ৭৮৮ সাল পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তিনি ৬ বছর আত্নগোপন থেকে আন্দালুসকে একত্রীকরার চেষ্টা করেন। পরবর্তিতে প্রায় ২৫ বছর সময় দিয়ে টলেডো, জারাগোজা, পেমপ্লোনা, বার্সেলোনাকে একত্রিত করতে সক্ষম হন। আমিরাত অব কর্ডোভা একশত পঞ্চাশ বছর তার বংশধররা শাসন করেন। আন্দালুসের বাহিরেও ছিল তাদের আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ। বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকার পশ্চিমের কিছু অংশের উপর তাদের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ছিল। খ্রিষ্টান সীমান্ত গুলোতে সতর্কতা ও নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করতো। খ্রিষ্টানদের চৌমুখি চক্রান্ত ও আমিরদের প্রতিযোগিতার ফলে নিয়ন্ত্রণ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, আমির আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ক্ষমতা খোদ কর্ডোবার বাইরে বিস্তৃত ছিল না।
প্রথম আব্দুর রহমানের পরিচয়:
প্রথম আব্দুর রহমান ছিলেন একজন উমাইয়া রাজপুত্র। তিনি উমাইয়া বংশের দশম খলিফা হিশামের দৌহিত্র ছিলেন। স্পেনের ইতিহাসে তিনি ‘আদ্-দাখিল’ নামে পরিচিত। ‘আদ্-দাখিল’ শব্দের অর্থ প্রবেশকারী বা সূচনাকারী। তিনি স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাতের সূচনা করায় অথবা পরাধীন উমাইয়া আমীরাত থেকে তিনি স্বাধীন উমাইয়া আমীরাতের সূচনা করায় তাঁকে এই উপাধি দেয়া হয়।
উত্তর আফ্রিকায় আগমন: ৭৫০ সালে জাব নদীর তীরে আব্দুর রহমান তাঁর ক্রীতদাস বদরকে নিয়ে প্যালেস্টাইন ও মিসর অতিক্রম করে উত্তর আফ্রিকায় গমন করেন। উত্তর আফ্রিকা ও স্পেন তখনও আব্বাসীয়দের অধীনতা স্বীকার করেনি। তখন উত্তর আফ্রিকার শাসক ছিলেন আব্দুর রহমান আল-হাবীব আল-ফিহরি এবং স্পেনে তাঁর পুত্র ইউসুফ আল-ফিহরি। স্পেনে সে সময় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছিল যা আব্দুর রহমানের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। আব্দুর রহমান বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ক্রীতদাস বদরকে গুপ্তচর হিসেবে স্পেনে প্রেরণ করেন। বদর ফিরে এসে সেখানকার অনুকূল অবস্থা বর্ণনা করেন। অন্যদিকে স্পেনের দক্ষিণ আরবীয় বা ইয়ামেনী নেতা আবদুল্লাহ্ ও উবায়দুল্লাহকে আব্দুর রহমান একটি চিঠি দিয়েছিলেন। চিঠি পেয়ে তারা ইয়ামেনীদের ঐক্যবদ্ধ করে আব্দুর রহমানকে একটি নৌকা পাঠিয়ে স্পেনে আগমনের আমন্ত্রণ জানান। আব্দুর রহমান এরকম একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি ৭৫৫ সালে আল- মুনেকার বন্দরে অবতরণ করেন। এবং ইয়েমেনীদের সহযোগিতায় কোন প্রতিরোধ ছাড়াই দক্ষিণ দিকের শহরগুলো দখল করলেন। এরপর তিনি কর্ডোভা অভিমূখে যাত্রা করেন। মাসারার যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করেন। ইমারাতে আমিরের দায়িত্বপালনে তিনি বেশ কিছু সংকটের মুখোমুখি হন এবং তা মোকাবিলা করেন। উল্লেখযোগ্য ঘটনা গুলো সংক্ষেপে তুলে ধরছি –
বিদ্রোহ দমন : মাসারার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইউসুফ টলেডোতে এবং তার সেনাপতি সুমায়েল জায়েনে পালিয়ে যান। পরে ইউসুফ জায়েনে সুমায়েলের সাথে মিলিত হয়ে বিচ্ছিন্ন সেনাবাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ইউসুফ কর্ডোভা দখল করেন। কিন্তু পরে রাজকীয় বাহিনীর অপ্রতিরোধ্য শক্তির মোকাবেলা করে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত হয়ে অব্দুর রহমানের সাথে চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী তার দুইপুত্র আবু জায়িদ ও আবুল আসওয়াদ মুহম্মদকে আব্দুর রহমান যামিন হিসেবে রাখেন এবং ইউসুফ ও সুমায়েল নির্বিঘ্নে তাদের সম্পত্তি ভোগ-দখলে রাখেন। এর ফলে দুবছর উভয়ের মধ্যে শান্তি বজায় থাকে। এরপর উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হলে ইউসুফ পালিয়ে মেরিদায় গমন করেন এবং ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। ৭৫৮ সালে লোকসার যুদ্ধে তিনি আব্দুর রহমানের বাহিনীর হাতে পরাজিত ও আহত হন এবং এর এক বছর পর টলেডোতে তার এক শত্রুর দ্বারা নিহত হন।
ইয়ামেনীদের বিদ্রোহ দমন : ক্ষমতা লাভের পর আব্দুর রহমানকে বিভিন্ন আরব গোত্রীয় কোন্দল ও ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়। ৭৬০ সালে আরজাক বিন নুমান গাচ্ছানি বিদ্রোহ করে সেভিল দখল করেন। রাজকীয় বাহিনী পাঠিয়ে সেভিল উদ্ধার করা হয় এবং আরজাক আত্মসমর্পণ করেন। ইয়ামেনী নেতা ও সেভিলের গভর্নর আবু সাব্বাহ আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে ৭৬৬ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যূত ও নিহত হন। এতে অন্যান্য ইয়ামেনী নেতাগণ বিদ্রোহী হয়ে অনেক মুদারীয়কে হত্যা করে। ৭৭৪ সালে আমীর তাদের বিদ্রোহ দমন করেন এবং তাদের ২০ হাজার সৈন্য নিহত হয়।
টলেডোর বিদ্রোহ দমন: ৭৬১ সালে টলেডোর প্রাক্তন শাসনকর্তা হিশাম বিন উরউয়াহ্ বিদ্রোহ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকবার অভিযান প্রেরণ করা হয়। শেষ পর্যন্ত ৭৬৪ সালে তিনি আত্মসমর্পণ করেন।
আব্বাসীয় অভিযান প্রতিহত : আব্দুর রহমান আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের নামে খুতবা পাঠ করলেও পরে তা বন্ধ করে দেন । আল-মনসুর স্পেনকে আব্বাসীয় খিলাফতের বলয়ে নিয়ে আসার জন্য কায়রোওয়ানের আব্বাসীয় গভর্নর আলা বিন মুগীসকে ৭৬৩ সালে স্পেনে পাঠান। আলা বিন মুগীস ৭০০০ বার্বার সৈন্যসহ নিহত হন। তাঁর মস্তক ছিন্ন করে আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের নিকট প্রেরণ করা হয়। খলিফা আব্দুর রহমানকে ‘সাকর কুরায়িশ” বা ‘কুরায়িশদের বাজপাখি’ (Falcon of the Quraysh) আখ্যা দেন। দ্রুততম সময়ে এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁকে বাজপাখির সাথে তুলনা করা হয়। এছাড়া আব্দুর রহমানের বীরত্ব ও দক্ষতায় কিছুটা আতঙ্কবোধ করে আল-মনসুর বলেছিলেন,“আমাদের ও এমন এক শত্রুর মধ্যে একটি সমুদ্র (ভূমধ্যসাগর) সৃষ্টির জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ।”
বার্বার বিদ্রোহ দমন: সান্তাব্রিয়াতে বার্বাররা আবদুল্লাহ্ নামের একজন স্কুল শিক্ষকের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে এবং তাদের এই বিদ্রোহ প্রায় ১০ বছর স্থায়ী হয়। ৭৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে একটি অভিযান প্রেরিত হলে তিনি জঙ্গলে আত্মগোপণ করেন এবং ৯ বছর পর অর্থাৎ ৭৭৭ সালে তিনি তার ২জন সহচরের হাতে নিহত হন ।
শার্লিমেনের অভিযান প্রতিহত : আব্দুর রহমান যখন দক্ষিণে বিদ্রোহী আরব ও বার্বারদের দমনে ব্যস্ত তখন উত্তর স্পেনের কতিপয় আরব নেতা ফ্রান্সের রাজা শার্লিমেনের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে স্পেন আক্রমণে প্ররোচনা দেয়। ৭৭৭ সালে শার্লিমেন পিরেনীজ অতিক্রম করে স্পেন আক্রমণ করেন এবং উত্তর স্পেনের কয়েকটি প্রদেশের ধ্বংস সাধন করেন। ৭৭৮ সালে তিনি সারাগোসায় আব্দুর রহমানের বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে ফ্রান্সে ফিরে যান ।
আব্দুর রহমানের কৃতিত্ব : আব্দুর রহমান ৭৮৮ সালে ৫৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৩২ বছর স্পেন শাসনকরে উমাইয়া আমীরাতকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর রাজ্যকে ছয়টি প্রদেশে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক প্রদেশের শাসনভার একজন গভর্নরের উপর ন্যস্ত করেন। তিনি একটি উপদেষ্টা পরিষদের পরামর্শক্রমে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। প্রশাসনের বিভিন্ন পদে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে তিনি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। মুদ্রা তৈরির জন্য তিনি কর্ডোভায় একটি টাকশাল নির্মাণ করেন। কর্ডোভার বিশ্ববিখ্যাত মসজিদটি তিনিই নির্মাণ করেন। এ মসজিদ সংলগ্ন একটি মাদ্রাসা নির্মিত হয়, যা পরবর্তীকালে কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। তিনি প্রায়শই প্রজাদের অভাব-অভিযোগ ও কর্মচারীদের আচরণ সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্য বের হতেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃতিমনা, সু-সাহিত্যিক ও জ্ঞানী-গুণীজনদের পৃষ্ঠপোষক। তিনি মাঝে মাঝে জ্ঞানী-গুণীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সাহিত্য সভার আয়োজন করতেন। ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া, ঈসা বিন দিনার, আবু মুসা হাওয়ারী, সাইদ বিন হাসান, ইবনে কায়েস প্রমূখ মনীষীগণ তাঁর দরবার অলংকৃত করেন।
প্রথম আব্দুর রহমান মৃত্যুর আগে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র হিশামকে (৮৮৮-৯৬) উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। হিশাম ছিলেন হুলাল নামক একজন স্পেনীয় দাসীর গর্ভজাত সন্তান। আব্দুর রহমানের অন্য দুই পুত্র ছিলেন সুলাইমান ও আবদুল্লাহ্ যারা তাঁর সিরীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান ছিলেন। হিশামের বুদ্ধিমত্তা ও ধার্মিকতার কারণে দাসীর সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে পরবর্তী আমীর হিসেবে মনোনীত করা হয়। পিতার আমলে তিনি মেরিদার গভর্নর ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর ৭৮৮ সালে ৩২ বছর বয়সে হিশাম নিজেকে স্পেনের আমীর হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁর শাসনামলে নানা ধরনের বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং তিনি সবগুলো বিদ্রোহ সফলভাবে মোকাবিলা করেন।
সোলাইমান ও আব্দুল্লাহর বিদ্রোহ মোকাবিলা : ক্ষমতা লাভের পরপরই ভাই সোলাইমান ও আব্দুল্লাহর বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে হয় হিশামকে । পিতা আব্দুর রহমানের জীবদ্দশায় হিশামের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদ্বয় সুলাইমান ও আবদুল্লাহ্ তাঁর মনোনয়নকে সমর্থন করলেও পিতার মৃত্যুর পর হিশাম শাসনক্ষমতা গ্রহণ করলে তাঁরা বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকেন। ৭৮৯/৯০ সালে তাঁরা টলেডোতে মিলিত হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আমীর তাঁদের সাথে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে যুদ্ধ হয় এবং সুলাইমান পরাজিত হয়ে মুর্সিয়াতে পলায়ন করেন। আবদুল্লাহ্ও সুলাইমানের পরাজয় এবং কম সৈন্যের কারণে বাধ্য হয়ে হিশামের বশ্যতা স্বীকার করেন। টলেডোর আশেপাশের জায়গা আবদুল্লাহকে জায়গীর দেয়া হয়। সুলায়মান মুর্সিয়াতে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। ৭৯০/৯১ সালে হিশামের পুত্র মুয়াবিয়া লোরকায় প্রচণ্ড যুদ্ধের পর চাচা সুলাইমানকে পরাজিত করেন। সুলাইমান ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাঁকে ক্ষমা করা হয় এবং স্পেন ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়।
পূর্ব স্পেনে বিদ্রোহ : হিশাম যখন ভাইদের সাথে দ্বন্দ্বে ব্যস্ত সেসময় পূর্ব স্পেনে ইয়ামেনীরা বিশৃংখলার সৃষ্টি করে। ৭৮৮ সালে সাইদ বিন হুসাইন বিন ইয়াহিয়া আল-আনসারীর নেতৃত্বে ইয়ামেনীরা তরতোসাতে বিদ্রোহ শুরু করে। এর ফলে বনু কাসী গোত্রের নও-মুসলিম নেতা মুসা বিন ফরতুনিও-এর নেতৃত্বে মুদারীয়গণ ঐক্যবদ্ধ হয় এবং উমাইয়া শাসনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সাইদ পরাজিত ও নিহত হন এবং তরতোসা মুসার হস্তগত হয়। এ সময় মাতরুহ নামের একজন নেতার নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা বার্সিলোনায় বিদ্রোহ করে এবং মুসার সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করে তরতোসা, সারাগোসা, বার্সিলোনা, তারাগোনা ও হুয়েস্কা দখল করে নেয়। ফলে এ সময় স্পেনে উমাইয়া অস্তিত্ব বিপন্ন হতে যাচ্ছিল। হিশাম তাদের দৃঢ় হস্তে দমনের চেষ্টা করেন। ৭৯১ সালে ভ্যালেন্সিয়ার গভর্নর আবু উসমান উবায়দুল্লাহ্ বিন উসমানকে মাতরুহের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়। সারাগোসা অবরুদ্ধ হয়। পরে মাতরুহ তাঁর নিজের লোকদের হাতে প্রাণ হারান। ফলে বিদ্রোহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে ও পরাজিত হয়। মুসা বিন ফরতুনিওকে সারাগোসার গভর্নর নিয়োগ করা হয়।
ফ্রান্স অভিযান : অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠার পর হিশাম মুসলিমদের পূর্ব শত্রু ও বিদ্রোহে উৎসাহদানকারী উত্তরের খ্রিস্টান নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ৭৯২ সালে আবু উসমানের নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী দক্ষিণ ফ্রান্সে অগ্রসর হয়। পরে এই সেনাবাহিনী দুভাগে বিভক্ত হয়ে অভিযান করে। একদলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল মালিক বিন আব্দুল ওয়াহিদ এবং আর একদলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল করিম বিন আব্দুল ওয়াহিদ। আব্দুল মালিক বিন আব্দুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী নার্বোনে ফ্রাঙ্কদের পরাস্ত করে নার্বোন ও জেরোনা জয় করে। এ সময় ফ্রান্সের রাজা শার্লিমেন ও তাঁর পুত্র লুইস জার্মানী ও ইতালীতে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। তুলুসের ডিউক উইলিয়াম মুসলিমদের বাধা প্রদান করেন এবং পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। মুসলিমরা সেপ্টিমানিয়া অধিকার করে নেয়। অন্যদিকে আব্দুল করিম বিন আব্দুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী গ্যালেসিয়া ও আস্তুরিয়া আক্রমণ করে। আস্তুরিয়ার রাজা প্রথম বারমুডো ও দ্বিতীয় আলফান্সোর সাথে মুসলিম বাহিনীর কয়েকবার মোকাবিলা হয়। শেষ পর্যন্ত মুসলিম বাহিনী তাদের পরাস্ত করে। কিন্তু মুসলিম বাহিনী ফেরার পথে খ্রিস্টানরা আক্রমণ করে এবং এতে মুসলিমরা পরাজিত হয়। ফলে উত্তর স্পেনে খ্রিস্টানরা আধিপত্য ধরে রাখে এবং মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে।
মালেকি মাযহাবের প্রবর্তন : হিশাম ধর্মানুরাগী ছিলেন। তিনি ফুকাহা বা ইসলামী আইন-বেত্তাদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ইমাম মালিক বিন আনাসের ভক্ত ও শিষ্য। ইমাম মালিক ৭১৫ সালে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। আব্বাসীয় আমলে শিয়া দাবীদার মুহম্মদ বিন আবদুল্লাহকে সমর্থন করার কারণে আল-মনসুর কর্তৃক তিনি নির্যাতনের শিকার হন। হিশাম তাঁকে স্পেনে আগমন ও বসতি স্থাপন করার অনুরোধ করেন। ইমাম মালিক আব্বাসীয় অত্যাচার সত্ত্বেও এই প্রস্তাবে রাযী হননি। তদুপরি হিশাম মদীনায় ইমাম মালিকের সাহচর্য এবং তাঁর থেকে জ্ঞান লাভ করার জন্য ছাত্রদের উৎসাহিত করতেন। তিনি এ মতবাদ স্পেনে প্রচারের জন্য প্রচেষ্টা চালান। স্পেনে ইমাম মালিকের শিষ্যদের মধ্যে ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া ও ঈসা বিন দিনার ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
হিশামের চরিত্র ও কৃতিত্ব প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা : ৮ বছর শাসন করার পর ৭৯৬ সালে ৪০ বছর বয়সে হিশাম করেন। হিশামকে উমাইয়া আমীরাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিনি উমাইয়া রাজ্যকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর তিন পুত্র উমায়িদ আল-মালিক, মুয়াবিয়া ও হাকামের সাহায্যে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে সমর্থ হন। প্রশাসনিক পদক্ষেপসমূহ : তিনি প্রশাসনিক ব্যক্তিদের অপ্রয়োজনে পরিবর্তন করেন নি এবং পিতার নিযুক্ত উযির ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ পদে বহাল রাখেন। তবে দুর্নীতিপরায়ণ ও অসৎ কর্মচারীদের বরখাস্ত করেন এবং তাদের কখনও পুনঃনিয়োগ দিতেন না। তিনি বেআইনী কর আদায় বন্ধ করে দেন এবং যাকাত ও সাদকাহ্ আদায়ের আদেশ দেন। তিনি সুশিক্ষিত লোকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।
জনকল্যাণমূলক কাজ : তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন এবং গোয়াদালকুইভির নদীর উপর নির্মিত সেতুর সংস্কার সাধন করেন। রাজধানীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য একটি সুন্দর ঝর্ণা নির্মাণ করেন। এছাড়া তিনি নতুন নতুন প্রাসাদ নির্মাণ ও পুরাতন সরকারী ভবন সংস্কার করেন। কর্ডোভার মসজিদের সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেন। এর ফলে এর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬০০ ফুট ও প্রস্থ হয় ২৫০ ফুট। ১২০০ বছর পরও এই মসজিদটির সৌন্দর্য ও আকর্ষণীয়তা বজায় রয়েছে। তিনি খাল ও পুকুর খনন করেন। তিনি দরিদ্রদের অর্থ বিতরণ করতেন।
ধার্মিকতা ও ন্যায়পরায়নতা: চরিত্রের দিক দিয়ে তাঁকে উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় উমরের (উমর বিন আব্দুল আযীয) সাথে তুলনা করা হয়। কারণ তিনি দ্বিতীয় উমরের মতই ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। দ্বিতীয় উমরের মত তিনিও তাঁর গোপন প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের অবস্থা দর্শন এবং প্রাদেশিক গভর্নর ও সরকারী কর্মকর্তাদের যোগ্যতা নিরূপণ ও তাদের কাজ-কর্মের খবরাখবর সংগ্রহ করতেন। তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন অথবা তাদের চাকুরী হতে বরখাস্ত করতেন। তিনি ধর্মীয় শিক্ষাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতেন। আরবী শিক্ষার জন্য অনেক বিদ্যালয় নির্মাণ করেন। হিশামের মৃত্যুর পর আল আন্দালুস কর্ডোভার আমিরের দায়িত্ব পালন করেন আল হাকাম ইবনে হিশাম।
আল-হাকাম ইবনে হিশাম ইবনে আবদুর রহমান ৭৯৬ থেকে ৮২২ সাল পর্যন্ত আল-আন্দালুসের আমিরের দায়িত্ব পালনকালে তার চাচা সুলায়মান ও আবদুল্লাহর কাছ থেকে বিরোধীতার সম্মুখীন হন। আবদুল্লাহ তার দুই পুত্র উবায়দুল্লাহ ও আবদুল মালিককে শার্লেমাইনের কাছে সাহায্যের জন্য আলোচনার উদ্দেশ্যে নিয়ে যান। এসময় সুলায়মান কর্ডোবা আক্রমণ করে পরাজিত হয়ে মেরিডার দিকে চলে যান।
আল-হাকাম তার শাসনের অধিকাংশ সময়ই টলেডো, সারাগোসা ও মেরিডার বিদ্রোহ দমনে ব্যয় করেন। বিদ্রোহীরা দুইবার কর্ডোবায় পৌছে যান। আল-হাকামকে অপসারণ করে তার এক ভাই সম্পর্কীয় আত্মীয়কে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনা করা হয়। এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর ৮০৬ সালের ১৬ নভেম্বর একটি ভোজসভায় ৭২ জন অভিজাতকে হত্যা করা হয়। কাউকে ক্রুশে ঝোলানো হয় ও গোয়াদালকুইভির নদীর তীরে প্রদর্শন করা হয়। এসময় এধরনের নিষ্ঠুরতা স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হত। কর্ডোবার ফটকে উত্তরের অভিযানের সময় বিদ্রোহী নেতা বা খ্রিষ্টানদের মাথা পরিদর্শন করানো হয়েছিল।
৮১৮ সালে গোয়াদালকুইভির নদীর দক্ষিণ পাড়ে আল-রিবাদ শহরতলীতে একটি বিদ্রোহ দমন করেন। প্রায় ৩০০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় ও ক্রুশে ঝোলানো হয়। বাকিদেরকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তাদের কেউ মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়ায়, কেউ ফেজ ও ক্রিট চলে যান। বাকিরা লেভেন্টের জলদস্যুদের সাথে যোগ দেন।
আল-হাকাম ২৬ বছর শাসন করে ৮২২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম হিশাম ও তার উপপত্নী জোখরুফের ছেলে। আল হাকামের মৃত্যুর পর আল আন্দালুস বা কর্ডোভার আমিরের দায়িত্ব পালন করেন তার পুত্র দ্বিতীয় আব্দুর রহমান। স্পেনের মুসলিম শাসনের ইতিহাসে তিনজন আব্দুর রহমানের শাসন আমল খুবই গুরুত্বপূর্ন । দ্বিতীয়আব্দুর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর বয়োবৃদ্ধ আবদুল্লাহ্ (প্রথম হিশামের ভাই) তাঞ্জিয়ার হতে সৈন্য সংগ্রহ করে স্পেনে আগমন করেন এবং বিদ্রোহ করে পরাজিত ও বন্দী হন। তাঁর পুত্রদ্বয় আসবাগ ও কাশিম বিদ্রোহী পিতাকে সাহায্য করেননি। পুত্রদ্বয়ের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা হলে তাঁকে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং তাঁকে মুরসিয়ার গভর্নর নিয়োগ করা হয়। দু’বৎসর পর সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
তুমির ও মেরিদায় বিদ্রোহ : তাঁর সময় তুমিরে হিমারীয় ও মুদারীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। মুদারীয়রা ছিল বেশি অশান্ত। মুদারীয় নেতা আবুল শামাখ মুহম্মদ বিন ইব্রাহিমকে রাজকীয় সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয় এবং তুদমির-এর রাজধানী লোরকা থেকে মুর্সিয়াতে স্থানান্তর করা হয়। এতে সংঘর্ষের অবসান হয়। মেরিদায় আব্দুল জব্বার ও সুলাইমান বিন মার্তিনের নেতৃত্বে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা বিদ্রোহ করে। আমীর তাদের বিদ্রোহ দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। টলেডোতে বিদ্রোহ : টলেডোতে হাশিম নামের এক কর্মকার নও-মুসলিমের নেতৃত্বে খ্রিস্টান, নও-মুসলিম ও ইহুদিরা বিদ্রোহ করে। ৮২৯ সালে কর্ডোভা থেকে হাশিম পরিবার টলেডোতে আগমন করে এবং লুটতরাজ, আরব-বার্বারদের গৃহ ধ্বংস, দুর্গ ধ্বংস এবং প্রহরীদের হত্যা করে। ৮৩১ সালে তাঁর বিরুদ্ধে সীমান্তের গভর্নর মুহম্মদ বিন ওয়াসিমকে পাঠিয়ে
তাকে পরাজিত ও হত্যা করা হয়।
খ্রিস্টান শাসকদের সাথে সংঘাত : এ সময় লিওনের প্রধান দ্বিতীয় আলফান্সো মুসলিম সীমান্তে তৎপরতা চালায় এবং উত্তরের অন্যান্য দলপতিরা তাকে অনুসরণ করে। আমীর ৮২৫ সালে আব্দুল করিম বিন মুগিস ও উবায়দুল্লাহকে পাঠিয়ে তাদের পরাজিত করেন এবং চুক্তির মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করা হয়। এ চুক্তি দশ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকে। পরবর্তীতে আস্তুরিয়া, গ্যালেসিয়া, আলভা ও ক্যাস্টিলে বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং বিদ্রোহীরা পাম্পলোনা ও বার্সিলোনা দখল করে নেয়। পরে আমীর সেনাবাহিনী পাঠিয়ে পাম্পলোনা, বার্সিলোনা, গ্যালিসিয়া, মদীনাতুস সালিম পুনরুদ্ধার করেন।
নরম্যান জলদস্যুদের দমন : ৮৪৪ সালে জার্মান নরম্যানরা ৮টি জাহাজ নিয়ে লুসিতানিয়া, লিসবন ও কেডিজ লুট করে । এরপর সেভিলে আসে এবং লুন্ঠন ও অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে । কর্ডোভা থেকে প্রেরিত আমীরের নৌবহর ও সেনাদলের তাড়া খেয়ে তারা আজেসিরাস ও উপকূলীয় অঞ্চলে হানা দেয়। সর্বশেষে তাদের সেখান থেকেও পলায়ন করতে বাধ্য করা হয়। এরপর আমীর একটি শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন। সেভিলে একটি জাহাজ নির্মাণ কারখানা গড়ে তোলা হয় এবং উপকূলীয় শহরগুলো সুরক্ষিত করা হয়। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান এর শাসন আমল ৮২২-৮৫২ সালে স্পেনের ধর্মান্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায় এক উদ্ভট ও অযৌক্তিক আন্দোলনের সূচনা করেন।
এ আন্দোলনের কারণ ছিল :
১. ইসলামের অধিকতর গ্রহণযোগ্যতার ফলে বহু খ্রিস্টান ইসলামে দীক্ষিত হয়। এতে ধর্মান্ধ খ্রিস্টানদের ঈর্ষা জন্মে।
২. আরব সভ্যতা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি একদল খ্রিস্টান আকৃষ্ট হয় এবং তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করেও আরবী ভাষা ব্যবহার, আরবীয় পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এদেরকে বলা হয় ‘মোযারব’। তারা আরবী ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করতে থাকে। এর ফলে ধর্মান্ধ খ্রিস্টানরা খ্রিস্টান ধর্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত হয়ে পড়ে।
৩. ক্যাথলিক ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে এসময় ইসলামের বিকাশ ঘটতে থাকে। ফলে খ্রিস্টান পাদ্রিরা নিজেদের ধর্মকে শক্তিশালী করার জন্য ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় ।
৪. স্পেনের খ্রিস্টানরা বরাবরই মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী মনে করে এবং তারা তাদের হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার ও মুসলিমদের বিতাড়নের জন্য জঘন্য প্রচারণায় লিপ্ত হয়। ধর্মান্ধ খ্রিস্টানরা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় এবং নবী মুহম্মদের (স.) বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে। তাদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় ইউলোজিয়াস, আলভারো, ফ্লোরা, মেরী, পারফেকটাস, আইজাক, সাঞ্চো, লিওক্রাটিয়া প্রমূখ। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান তাদেরকে আন্দোলন হতে নিভৃত করতে খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের নিয়ে মহাসম্মেলনের আয়োজন করেন। সম্মেলনে ধর্মান্ধদের অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধের আহ্বান জানালেও তারা তা অমান্য করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ৮৫০ সালে আমীর তাদের মধ্যে ১১ জন ধর্মান্ধকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও বহু সংখ্যককে কারারুদ্ধ করলে আন্দোলন সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়। পরে প্রথম মুহম্মদের (৮৫২-৮৬) সময় আন্দোলন আবার চাঙ্গা হয়। ৮৫৯ সালে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেয়ার মাধ্যমে এই আন্দোলন বন্ধ হয়।
বৈদেশিক সম্পর্ক : ৮৪০ সালে বাইজানটাইন সম্রাট থিওফিলাস মূল্যবান উপহারসহ কর্ডোভায় একটি প্রতিনিধিদল পাঠান। জবাবে তিনিও কনস্টানটিনোপোলে একটি প্রতিনিধিদল পাঠান। এ সময় নাভারের কাউন্ট ফ্রান্সের অধীনতা থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং একটি শক্তিশালী মিত্রের সন্ধানে কর্ডোভায় একটি প্রতিনিধিদল পাঠান। একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে বলা হয় মুসলিমরা কাউন্টকে বহিঃশক্তির আগ্রাসন থেকে রক্ষা করবে এবং নাভারে এর বিনিময়ে পিরেনীজ অতিক্রম করে তাদের ফ্রান্সে আক্রমণে সাহায্য করবে।
চার ব্যক্তির প্রভাব : দ্বিতীয় আব্দুর রহমান তাঁর শাসনকালব্যাপী ৪ জন ব্যক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এঁরা হলেন ধর্মতত্ত্ববিদ ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া, সঙ্গীতজ্ঞ যিরীয়াব, খোজা নসর ও সুলতানা তারুব। ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া প্ৰথম হিশামের সময় ইমাম মালিক বিন আনাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে স্পেনে মালিকী মাযহাব ও কিতাবুল মুয়াত্তা গ্রন্থের ব্যাপক প্রচার ঘটান। প্রথম হাকামের বিরুদ্ধে ফকীহ ও নও-মুসলিমদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেও তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের সময় তিনি অতি বৃদ্ধ হলেও আমীর তাঁকে খুব ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সমাদর করতেন এবং দরবারের শ্রেষ্ঠ আসন প্রদান করেন। জনগণ তাঁর মাধ্যমে ফরিয়াদ করলে আমীর তা মঞ্জুর করতেন। পারস্যের অধিবাসী যিরীয়াব প্রথমে আব্বাসীয় দরবারের সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। ওস্তাদ ইসহাক মওসিলির নির্দেশে বাগদাদ ত্যাগ করে আঘলাবী দরবারে যান। সেখানেও তাঁর স্থান হয়নি। অবশেষে দ্বিতীয় হাকামের আমন্ত্রণে স্পেনে আসেন। কিন্তু তিনি স্পেনে পৌঁছার পূর্বেই হাকামের মৃত্যু ঘটে। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান ক্ষমতালাভ করে তাঁকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন এবং তাঁর জন্য ভাল বেতন- ভাতার ব্যবস্থা করেন। সঙ্গীতে বিভিন্ন সুর, ছন্দ তৈরী করেন; বীণায় ৫ম তারের সংযোজন করেন; বিভিন্ন যন্ত্র আবিস্কার করেন; এবং স্পেনে সঙ্গীত নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। সঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি অঙ্গসজ্জা, রূপচর্চা, গৃহসজ্জা, ভোজন, পোশাকের ব্যবহার রীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনয়নের ব্যাপারেও অবদান রাখেন। অর্থাৎ স্পেনে বিভিন্ন ফ্যাশন ও পারসিক রীতি প্রবর্তন হয় তাঁর মাধ্যমে। ক্রীতদাস খোজা নসর সুলতানা তারুবের প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং রাজকার্যে প্রচুর দক্ষতার জন্য তিনি প্রধান সচিব পদ লাভ করেছিলেন। তাঁর উপর আমীর রাজকাজের দায়িত্ব দিয়ে সঙ্গীত আসরে বিনোদন করতেন। কিন্তু সুলতানা তারুব তাঁকে দিয়ে যুবরাজ আবদুল্লাহকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করেন। ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে তাঁকে সেই বিষ পাণ করিয়েই হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের স্ত্রী তারুব ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। স্বর্ণালংকারের প্রতি তাঁর বিশেষ লোভ ছিল। আমীর তাঁর সব চাহিদা পূরণ করতেন। কিন্তু পুত্র আবদুল্লাহকে হত্যার ষড়যন্ত্রের পর আমীর তাঁকে অন্য চোখে দেখতেন এবং তাঁর প্রভাব দিনে দিনে কমতে থাকে।
দ্বিতীয় আব্দুর রহমান এর মৃত্যুর পর আল আন্দালুসের শাসনভার গ্রহণ করেন প্রথম মুহাম্মাদ। তিনি ৮৫২ থেকে ৮৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তার শাসনামলে মুলাদি (ইবেরিয়ান জাতিগোষ্ঠির মুসলমান) ও মুজারাবদের (মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের খ্রিষ্টান বাসিন্দা) কর্তৃক কিছু বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। বনু কাসি মুলাদি পরিবারের মুসা ইবনে মুসা নাভার রাজ্যের আরিস্টা পরিবারের সাথে মিত্রতা করে বিদ্রোহ করে নিজেকে স্পেনের তৃতীয় রাজা দাবি করে। বিদ্রোহে উমাইয়া কর্মকর্তা ইবনে মারওয়ান মেরিডাও যোগদেন এবং আমিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। আমির তাকে দমনে ব্যার্থ হয়ে ৮৭৫ সালে স্বাধীন শহর গড়ে তুলতে অনুমতি দেন। ৮৮০ সালে ভিসিগথ বংশোদ্ভূত উমর ইবনে হাফনুস বিদ্রোহ করেন। তার এ বিদ্রোহ ৯২৮ পর্যন্ত চলমান ছিল। অভ্যান্তরীন কোন্দল ও খ্রিষ্টানদের নানান ষড়যন্ত্রে মোকাবিলা করেই প্রথম মুহাম্মদ শাসন কার্য পরিচালনা করেন। ৮৮৬ সালে তার মৃত্যুর পর পুত্র আল মুনজির উত্তরাধিকারী হন। পিতা মৃত্যুর পর ৮৮৬ থেকে ৮৮৮ সাল মাত্র দুইবছর তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এ দুই বছরে বিদ্রোহী উমর ইবনে হাফসুনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে ক্ষমতায় থাকতে হয়। ৮৮৮ সালে তার রহাস্যজনক মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ তার উত্তরাধিকারী হন।কর্ডোভা আমিরাতের সপ্তম আমির আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ । ৮৮৮ থেকে ৯১২ সাল পর্যন্ত তিনি শাসন করেন।তার শাসনামলে আরব, বার্বার ও মুলাদিদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তার ক্ষমতা কর্ডোভার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বাকি অঞ্চলগুলো বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। ৯০১ সালে তিনি ইবনে হাফসুনের সাথে শান্তিচুক্তি করেন। তবে কয়েকবছর পর আবার যুদ্ধ শুরু হয়। আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর তা থেমে যায়। তার এক ভাই তার উত্তরাধিকারী ঘোষিত পুত্রকে হত্যা করেন। পরে হত্যাকারীকে হত্যা করা হয় এবং আবদুল্লাহর মৃত পুত্রের পুত্র তৃতীয় আব্দুর রহমানকে উত্তরাধিকারী করেন। তিনি ছিলেন কর্ডোভা উমাইয়া বংশীয় আমির ও খলিফা (৯১২- ৯২৯ আমির ৯২৯-৯৬১খলিফা)। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি আমির হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা শুরু করেন পঞ্চাশ বছর যাবত ইবেরিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক হিসেবে শাসন করেন। তার শাসনামলে সব বিশ্বাসের মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করে। তবে তিনি ফাতেমীয়দের বিরুদ্ধে ছিলেন। উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমীয়দের শত্রুদের তিনি সমর্থন দেন। ১৬ জানুয়ারি ৯২৯ সালে তিনি নিজেকে খিলাফত অব কর্ডোভার খলিফা ঘোষণা করেন।
চলবে…