গত ৬ ফেব্রুয়ারী সোমবার দুপুর ১২টায় পল্টনস্থ দলীয় কার্যালয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। উক্ত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে দলের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন:
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে নতুন প্রজন্মের মুসলিম জাতিসত্তা ধ্বংসের পরিকল্পনা দেখে চরম উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা নিয়ে আমরা আজ এই সংবাদ সম্মেলন আহবান করতে বাধ্য হয়েছি। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে,বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে এমন অনেক বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে যা এদেশের মানুষের বোধ-বিশ্বাস ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিপূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। বিতর্কিত এই শিক্ষা সিলেবাসে ইসলামের অকাট্য বিধান পর্দাকে বিকৃত রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে, সুকৌশলে চালানো হয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং অস্বীকার করা হয়েছে ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলের গৌরবময় ইতিহাস। আমরা আজ আপনাদের মাধ্যমে সরকার ও সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে সংক্ষেপে এর কিছু চিত্র তুলে ধরছি।
১. ষষ্ঠ শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” বইয়ে বিবর্তনবাদকে প্রমোট করে বলা হয়েছে: মানুষ কোথা থেকে এল! শুরু থেকে মানুষ একই রকম থাকেনি। বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের বর্তমান রূপে আসা। বিবর্তন হলোই বা কী ভাবে? এই বইয়ে বিবর্তনবাদকে বুঝাতে গিয়ে বিভিন্ন যুগের মানুষের বিবর্তিত একাধিক ছবিও দেখানো হয়েছে। এসব ছবি মূলত বিবর্তনেরই প্রমাণ স্বরূপ বইয়ে দেওয়া হয়েছে,অথচ আমাদের আক্বীদা-বিশ্বাস হল:এই পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ আদিকাল থেকেই পূর্ণাঙ্গরূপে সৃজিত হয়েছে এবং তা মহাজ্ঞানী স্রষ্টা মহান আল্লাহরই নিপুন সৃষ্টি। ন্যায়নিষ্ঠ বিজ্ঞানীরা এই চিরন্তন সত্যকে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং বিবর্তনবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সুতরাং বিবর্তনবাদ ঈমানবিরোধী একটি কুফরী মতবাদ।পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত দ্বারা এটিই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সত্য। যারা বিজ্ঞানী পরিচয় ধারণ করে এই অবৈজ্ঞানিক দর্শনটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন তারা মূলতঃ মরীচিকার পেছনেই নিরন্তর ছুটছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।
২. সপ্তম শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” বইয়ের ৫১ নং পৃষ্ঠা থেকে আরম্ভ হওয়া “শরীফার গল্প” নামক আলোচনাটি এই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ বলে আমরা মনে করি। কারণ এই আলোচনাটিতে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমদানিকৃত বিকৃত মতবাদের দীক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। এ রকম আলোচনা ও পাঠ দ্বারা সমকামিতাসহ নানা ধরণের বিকৃত ও অবাধ যৌনাচারের দিকে কিশোরদের আকৃষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
৩. সপ্তম শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” (অনুশীলন)বইয়ের ১২১ পৃষ্ঠায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা “অবরোধবাসিনীর” কাহিনীতে এমন কিছু অংশ উল্লেখ করা হয়েছে যা দ্বারা ইসলামী শরীয়তের ফরজ বিধান পর্দার প্রতি বিদ্বেষ ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেয়েছে বলে আমরা মনে করি। বোরকাপরিহিতা বা পর্দা করা নারীদেরকে নির্বোধ ও মূর্খ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে অবরোধবাসিনী। বোরকা-হিজাব পরার কারণে তারা কী ভাবে আগুনে পুড়ে মরছে! কী ভাবে ট্রেনের নীচে কাটা পড়ছে! ডাক্তাররা কী ভাবে রাগ করে বোরকাপরা রোগী না দেখে চলে যাচ্ছে! কী ভাবে তারা রেলওয়ে কর্মচারীর লাথি খাচ্ছে! ইত্যাদি কথাগুলো এই লেখাতে তুলে ধরা হয়েছে। এ সব তুলে ধরে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে পর্দার প্রতি ভীতি ও ঘৃণা তৈরির অপচেষ্টা করা হয়েছে। একটি মুসলিম দেশে পর্দার প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যসম্বলিত এমন লেখা পাঠ্যপুস্তকে কী ভাবে স্থান পেল? তা ভেবে আমরা কোন কুল-কিনারা পাচ্ছি না।
৪. ষষ্ঠ শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” (অনুশীলন) বইয়ের ১৭ নং পৃষ্ঠায় দাড়িকে বোকার প্রতীক হিসেব উপস্থাপন করা হয়েছে। এই পৃষ্ঠায় দাড়ি নিয়ে বিদ্রুপাত্মক বিভিন্ন বাক্য লেখা হয়েছে। যেমন- “তুমি মোটেও ভালুক না। একটা বোকা হাঁদারাম মানুষ যার দরকার দাড়ি চাঁছা”
“তুমি একটা বোকা মানুষ যার দরকার দাড়িগুলো চাঁছা”
“ম্যানেজার বলল-ভালুকটা একটা গবেট যার দরকার ভাল করে শেভ করা আর সে পরে একটা পশমের কোট”
৫.সপ্তম শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” (অনুশীলন) বইয়ের ৩য় পৃষ্ঠায় ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজিকে দখলদার হিসেবে দেখানো হয়েছে।এতে বলা হয়েছে যে,সুদূর তুরস্ক থেকে আগত ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি১২০৪ সালে আঞ্চলিক বাংলার উত্তর এবং পশ্চিম সীমানার বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেন। এই দখলের প্রক্রিয়ায় তিনি বেশ কিছু বিহার এবং পাঠাগার ধ্বংস করেন। বখতিয়ার খলজির হাত ধরেই বাংলা অঞ্চলে মুসলমানদের শাসন শুরু হয়। এভাবে আরো অনেক জায়গায় ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলের গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃতরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।
৬. ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” বই দুটির প্রচ্ছদেও ভিনদেশী সংস্কৃতিকে প্রমোট করা হয়েছে। এমন প্রচ্ছদ কোন ভাবেই আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কৃষ্টি-সভ্যতাকে রিপ্রেজেন্ট করে না।
জমিয়ত মহাসচিব তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন:
অতি সম্প্রতি মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীর বক্তব্য আমাদের নজরে এসেছে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ সব অসংগতির বিষয়ে আলাদা আলাদা দুটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে আমরা জেনেছি কিন্তু উপরোল্লিখিত জটিল বিষয়গুলোকে শুধু অসংগতি কিংবা ভুল বলে উপস্থাপন করাটাও আমাদের কাছে চরম আশ্চর্যের ব্যাপার। আমরা বরং মনে করি: ঈমানী আক্বীদা-বিশ্বাস ও ইসলামী মূল্যবোধপরিপন্থী উপরোক্ত বিষয়গুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত হওয়াটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ এবং পূর্বপরিকল্পিত। তাই সরকারকে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন পূর্বক প্রকৃত দোষীদেরকে চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে বিজাতীয় আগ্রাসন বন্ধ, অনৈসলামিক ও বিতর্কিত বিষয়গুলো বাতিল করে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে একাধিক বিশেষজ্ঞ আলেমকে যুক্ত করতে হবে। এর পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
উক্ত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মাওলানা শাহিনুর পাশা চৌধুরী,যুগ্মমহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া,মাওলানা লোকমান মাজহারী,মাওলানা শোয়াইব আহমদ চৌধুরী,মাওলানা মতিউর রহমান গাজিপুরী,সহকারী মহাসচিব মাওলানা বশীর আহমদ,সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতী নাসীরুদ্দীন খান,ঢাকা মহানগর উত্তর জমিয়তের সভাপতি মাওলানা মকবূল হোসাইন কাসেমী,অর্থ সম্পাদক মুফতী জাকির হোসাইন কাসেমী,সহ-অর্থ সম্পাদক মাওলানা আবুল বাশার,প্রচার সম্পাদক মাওলানা জয়নুল আবেদীন,সহ-প্রচার সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা নূর মোহাম্মদ কাসেমী,অফিস সম্পাদক মাওলানা আব্দুল গাফফার ছয়ঘরী,কেন্দ্রীয় যুব বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক মুফতী বশীরুল হাসান খাদিমানী,মাওলানা তোফাজ্জল হোসেন প্রমূখ নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব মাওলানা আফেন্দী আরো বলেন:
মৌলিক ভাবে বর্তমান পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আজকের এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও সমসাময়িক রাজনৈতিক ও জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কেও আপনাদের মাধ্যমে আমরা আরো কিছু দাবী-দাওয়া পেশ করছি। যা ইতিপূর্বেও আমরা দলীয় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বারংবার বলে আসছি।
* সরকারকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার জনদাবী মেনে নিতে হবে।
* দলীয় নেতৃবৃন্দসহ কারাবন্দী আলেমদেরকে দ্রুত মুক্তি দিতে হবে এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমদরকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে কোর্টে আনা বন্ধ করতে হবে। এটা শুধু দৃষ্টিকটুই নয় বরং অমনবিকও বটে।
* বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে এবং আসন্ন মাহে রমজানকে সামনে রেখে মজুতদারি ও কালোবাজারি রোধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
* দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচারকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে ফেরত আনার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
*কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয় ভাবে অমুসলিম ঘোষণা এবং খৃষ্টান মিশনারীর প্রতারণামূলক কার্যক্রম বন্ধে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পাঠ্যপুস্তক ইস্যু নিয়ে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম উত্তর গেইটে ঢাকা মহানগর জমিয়ত উত্তর ও দক্ষিণের যৌথ উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। ইনশাআল্লাহ।