আহমদ শফীর মৃত্যুতে হেফাজত, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও হাইআতুল উলয়ার শীর্ষ পদ শূন্য। নেতৃত্ব ঠিক করতে কাল বৈঠক।
হেফাজতের আগে বেফাক নিয়ে তৎপর দুই পক্ষ
হেফাজতে ইসলামের আমির কে হচ্ছেন, এই আলোচনার চেয়ে কওমি আলেম সমাজের আগ্রহের বড় বিষয়, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার (বেফাক) সভাপতি পদে কে আসছেন। শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুতে কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা বোর্ড বেফাকের শীর্ষ পদটিও শূন্য হয়ে পড়েছে।
হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী একই সঙ্গে বেফাকের সভাপতি এবং কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সরকার গঠিত সংস্থা আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান ছিলেন। বেফাকের প্রধানই হাইয়াতুল উলয়ার চেয়ারম্যান হবেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর এই তিনটি পদই শূন্য হয়ে গেছে।
কওমি মাদ্রাসা–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, হেফাজতে ইসলাম ও বেফাকের নেতৃত্ব নিয়ে নানামুখী তৎপরতা চলছে। এ নিয়ে সরকারঘনিষ্ঠ ও সরকারবিরোধী মনোভাবাপন্ন দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়েছে।
অবশ্য আহমদ শফীর জীবদ্দশাতেও হেফাজত ও বেফাকে দুটি পক্ষ ছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর হেফাজতে ইসলামে দুটি পক্ষ তৈরি হয়। এরপর থেকে শাহ আহমদ শফীকে সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হতো। তবে কেউ তাঁর কথার বাইরে যাননি। এখন সংগঠন দুটির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে দুই পক্ষের জোর তৎপরতা চলছে। এই মুহূর্তে সবার দৃষ্টি বেফাককে ঘিরে। হেফাজতের মতো বেফাকও কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেফাকের অধীন ছয়টি স্তরের সারা দেশের ১৩ হাজার মাদ্রাসা আছে। এসব মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। কওমি শিক্ষার সনদের সরকারি স্বীকৃতি থাকায় এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। এই সুবাদে সরকারের সঙ্গে কওমি আলেমদের যোগাযোগও বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হেফাজতের আমির ও কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের সভাপতি পদে তিন–চারজনের নাম আলোচনায় আছে। তাঁদের মধ্যে বেফাকের চেয়ারম্যান পদে ঢাকার জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার মুহতামিম (প্রধান) নূর হোসাইন কাসেমী এবং দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মুহতামিম মাহমুদুল হাসানের নাম বেশি আলোচনায়। এই দুজনের নাম হেফাজতের আমির পদের জন্যও আলোচনায় আছে। এ ছাড়া হেফাজতের বর্তমান মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী ও তাঁর মামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর নামও আছে। জুনায়েদ বাবুনগরী এখন হাটহাজারী মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস ও শিক্ষাসচিব। আর মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ফটিকছড়ির আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদ্রাসার মুহতামিম। এঁদের বাইরে জ্যেষ্ঠ আলেম মেখল হামিউস সূন্নাহ মাদ্রাসার মুহতামিম নোমান ফয়েজীকে নিয়েও ভাবছেন কেউ কেউ।
এদিকে জুনায়েদ বাবুনগরী যদি হেফাজতের আমির হন, তাহলে সংগঠনের মহাসচিব পদে নতুন কেউ আসবে। মহাসচিব পদে তরুণ ইসলামি বক্তা মামুনুল হককে নিয়ে বেশি আলোচনা চলছে। তিনি প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ছোট ছেলে। এখন প্রশ্ন উঠছে, কী প্রক্রিয়ায় হেফাজত ও বেফাকের নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে।
হেফাজতের বিষয়ে আলোচনায় থাকা নূর হোসাইন কাসেমী দৈনিক ডাক বাংলাকে বলেন, ‘আমি নিজে পদ-পদবির চাহিদা পোষণ করি না। সংগঠনের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী মহাসচিব নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য সম্মেলন আহ্বান করবেন। কাউন্সিলরদের প্রকাশ করা মতামতের ভিত্তিতেই নতুন নেতা নির্বাচিত হবেন।’
অবশ্য মৃত্যুর দুদিন আগে ১৬ সেপ্টেম্বর আকস্মিক ছাত্র বিক্ষোভের মুখে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় শাহ আহমদ শফীর নিয়ন্ত্রণ ছুটে যায়। তিনি মহাপরিচালক থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং ছেলে আনাছ মাদানিকেও মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি দেন। এরই মধ্যে হাটহাজারী মাদ্রাসা পরিচালনায় তিন সদস্যের যৌথ নেতৃত্ব ঠিক করেছে মজলিসে শুরা।
এখন আহমদ শফীর অনুসারীরা বেফাক ও হেফাজতের শীর্ষ পদে পছন্দের ব্যক্তিদের বসিয়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। তাঁদের প্রতি সরকারঘনিষ্ঠ মহলের সমর্থন রয়েছে বলে জানা গেছে। এই অংশ যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মুহতামিম মাহমুদুল হাসানকে বেফাকের শীর্ষ নেতৃত্বে বসাতে তৎপর বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। মাহমুদুল হাসান গুলশানের আজাদ মসজিদেরও খতিব। তিনি আগে বেফাকে সক্রিয় ছিলেন না। ২০১৭ সালে বেফাকে যোগ দেন।
বর্তমানে বেফাকের কো–চেয়ারম্যান পদে আছেন পুরান ঢাকার জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদ্রাসার মুহতামিম আবদুল কুদ্দুছ। সম্প্রতি তাঁর একটি ফাঁস হওয়া ফোনালাপে বেফাকে অনিয়মের কিছু ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর তিনি সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তিনি গত ২৩ সেপ্টেম্বর বেফাকের সভায় পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এখন তাঁর পদটি পেতে সক্রিয় আছেন যশোর মাদানি নগর মাদ্রাসার মুহতামিম ও সাবেক সাংসদ মুফতি ওয়াক্কাছ। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একাংশের সভাপতি। তাঁর দল বিএনপির জোটে থাকলেও নিষ্ক্রিয়। কারণ, নূর হোসাইন কাসেমীর নেতৃত্বাধীন জমিয়ত বিএনপির জোটে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ কারণে মুফতি ওয়াক্কাছ এখন হেফাজত ও বেফাকের বিষয়ে আগের অবস্থান বদলে আহমদ শফীর অনুসারীদের সমর্থন নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
অবশ্য মুফতি ওয়াক্কাছ দৈনিক ডাক বাংলাকে বলেন, ‘এখন আমরা ব্যস্ত বেফাক নিয়ে, হেফাজত পরে। বেফাকের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব যিনি হবেন, তাঁকে নন–পলিটিক্যাল হতে হবে। এ দুটি পদ নন–পলিটিক্যাল।’
বেফাকের মহাসচিব পদে আলোচনায় আছে মাহফুজুল হক ও মুসলেহ উদ্দিনের নাম। মুসলেহ উদ্দিন সিলেটের গওহরপুর মাদ্রাসার মুহতামিম। তিনি বর্তমানে বেফাকের সহসভাপতি। তাঁর পক্ষে আহমদ শফীর অনুসারীরা সক্রিয় বলে জানা গেছে। আর মাহফুজুল হক হলেন শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের ছেলে। তিনি মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম। বর্তমানে বেফাকের যুগ্ম মহাসচিব।
মাহফুজুল হক দৈনিক ডাক বাংলাকে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে আশাবাদীও না, কোনো পদের জন্য প্রত্যাশীও না। আমার দ্বারা প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে মনে করলে এবং মুরব্বিরা দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে নিশ্চয়ই বিবেচনা করব।’
কাল ৩ অক্টোবর রাজধানীর কাজলার ভাঙা প্রেস এলাকায় বেফাকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তাদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের (মজলিসে আমেলা) সভা হবে। সেখানেই পরবর্তী নেতৃত্ব ঠিক করা হবে বলে জানা গেছে।