কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না বাল্যবিয়ে। কন্যাশিশুর নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় সরকারি-বেসরকারি বহু উদ্যোগের পরও নীরবে-নিভৃতে চলছে বাল্যবিয়ে। করোনায় অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, শিশুর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় বাল্যবিয়ের দিকে ঝুঁকছেন অভিভাবকরা। কন্যাশিশুর জন্ম সনদে কারচুপি, বয়স লুকিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যাসন্তানকে বিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহর, সবখানেই অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যাশিশুকে বিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। অনেক ক্ষেত্রে রাতের আঁধারে শেষ করা হয় বিয়ের আয়োজন। বর্তমানে করোনায় বিয়ের অনুষ্ঠান না করতে সরকারের নির্দেশনার সুযোগে লোকচক্ষুর আড়ালে গোপনে কন্যাশিশুকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জন্ম সনদে অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যার বয়স বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিয়ে। ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, শিশু ও বাল্যবিয়ে নিয়ে কাজ করা কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে উল্লেখ্যযোগ্য কাজ করলেও পুরোপুরি থামানো যায়নি বাল্যবিয়ে। করোনা মহামারির এই সময়ে আর্থিক অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় বাল্যবিয়ে দেওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় মাল্টিসেক্টরাল প্রগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, করোনাকালে এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত দেশে মোট ৩৩০টি বাল্যবিয়ের খবর পেয়েছে মন্ত্রণালয়। এদিকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) পক্ষ থেকে দেশের ৫৩টি জেলার মোট ৫৭ হাজার ৭০৪ নারী ও শিশুর ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, চলতি বছরের শুধু জুন মাসে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৪৬২ জন কন্যাশিশু। মে মাসের তুলনায় জুন মাসে বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। মে মাসে বাল্যবিয়ের সংখ্যা ছিল ১৭০। অন্যদিকে কমে গেছে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের সংখ্যা। গত মে মাসে ২৩৩টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা গেলেও জুন মাসে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা গেছে ২০৭টি। ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, দেশে যেসব এলাকায় ব্র্যাকের কার্যক্রম চলমান, সেখানে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত মোট ৩৩০টি বাল্যবিয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২২০টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করে ব্র্যাক।
এমজেএফের ওই জরিপে করোনাকালে বাল্যবিয়ে বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ করোনাবিষয়ক ত্রাণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে তেমনভাবে নজর দিতে পারেনি। এ ছাড়া করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, অভাব, পাড়া-প্রতিবেশীর প্রভাবে অভিভাবকরা আইন লঙ্ঘন করে কন্যাশিশুদের গোপনে বিয়ে দিচ্ছেন।
শিশুর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ জানান, দরিদ্র পরিবারগুলোয় ‘বয়স বাড়লে মেয়ের চেহারার আকর্ষণ কমে যাওয়া এবং সে কারণে বিয়েতে মোটা অঙ্কের যৌতুক দেওয়া’ থেকে বাঁচতে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে বিয়ের আগে মেয়েরা যাতে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়ে সে জন্য বাল্যবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার পরিবারগুলো, বিশেষ করে বন্যাপ্রবণ এলাকার পরিবারগুলো অনিশ্চয়তা থেকে তাদের মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারগুলো সংসারের খরচ চালিয়ে কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পেরে কম বয়সে বিয়ে দিচ্ছে।
ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রগ্রামের প্রধান সেলিনা আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেকেরই নারী ও শিশুর প্রতি ইতিবাচক কোনো মনোভাব নেই। তাঁরা নারীকে বোঝা মনে করেন। তাই তাঁরা সব সময় এই বোঝা থেকে নিস্তার পেতে চান। ফলে সহজ সমাধান হিসেবে বাল্যবিয়েকে বেছে নেন। আর করোনা মহামারির মধ্যে অভিভাবকদের অনেকের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এই অনিশ্চয়তার জায়গা থেকেও অনেকে বাল্যবিয়ের দিকে ঝুঁকছেন। এ ছাড়া আইনের শাসন বাস্তবায়ন এবং পর্যাপ্ত তদারকি না থাকায় বাল্যবিয়ের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।’ বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে এ সময় তিনি শিশুর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।