স্বেচ্ছাসেবকেরা মোটরসাইকেলের মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রী মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে এর আগেও তাঁরা নানা অসাধ্য সাধন করেছেন। কখনো বিদ্যুৎপৃষ্টে দুই হাত হারানো এতিম তরুণকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছেন। কখনোবা অপহরণের শিকার শিশুকে উদ্ধার করেছেন ‘দুঃসাহসিক অভিযান’ চালিয়ে। চলমান মহামারিতে আবারও তাঁরা দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে। এবারও যথারীতি তাঁদের মানবসেবার মাধ্যম ফেসবুক।
এসবের পেছনে আছেন চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের তিন তরুণ। তাঁরা হলেন হান্নান তারেক, জাহিদ হাসান ও ফিরোজ খান। নিজেদের ব্যবসা সামলানোর অবসরে এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানোই যেন তাঁদের নেশা। করোনার এই সময়ে এবার তাঁরা তহবিল সংগ্রহ করে এলাকার অন্তত ৮০০ পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন ১৭ টন খাবার ও অর্থ। আর এসব কাজে এই তরুণদের সহায়তা করেছেন ৮ থেকে ১০ জন স্বেচ্ছাসেবক।
এই তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে এপ্রিলের শুরু থেকে তাঁরা ফেসবুকের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত সন্দ্বীপের বাসিন্দাদের অনেকেই অনুদান পাঠাতে থাকেন। কিছু অনুদান মিলতেই তাঁরা শুরু করে দেন ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। তিন ভাগে তাঁরা কার্যক্রম চালিয়েছেন। প্রথম দফায় ৩০০ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দরিদ্র মানুষকে তাঁরা ত্রাণ দেন। এরপর আরও ৩০০ প্রবাসী পরিবার, যারা খুব কষ্টে দিন যাপন করছিল, তাদের ১০ টাকায় ৩৫-৩৮ কেজির খাদ্যসহায়তা দেন। পরে ২০০ অসহায় পরিবারের হাতে ১ হাজার টাকা করে তুলে দেন। স্বেচ্ছাসেবকেরা মোটরসাইকেল ও গাড়ি নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে এসব খাদ্যসহায়তা মানুষের হাতে তুলে দেন।
এভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েও প্রচারের আলোয় থাকতে অপছন্দ এই তরুণদের। তাঁদেরই একজন হান্নান তারেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম আগের মতো নিভৃতে কাজ করতে। তাই খাদ্যসহায়তা দেওয়ার সময় কোনো ছবি তুলে সাহায্যপ্রার্থীকে বিব্রত করিনি। মূলত আগে থেকেই মানুষের জন্য নানা কাজ করে যাচ্ছি, তা জেনেই প্রবাসীরা সহায়তা পাঠাতে শুরু করেন। আবার এলাকার সচ্ছল ব্যক্তিরাও এগিয়ে আসেন। ৫০০ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আমরা অনুদান পেয়েছি। সব মিলিয়ে প্রায় সাত লাখ টাকা সহায়তা পাই।’
খাবারের প্যাকেট তৈরি করছেন সন্দ্বীপের স্বেচ্ছাসেবকেরা।
অন্য দুই তরুণের বক্তব্যও একই। তাঁরা এর কৃতিত্বের পুরোটাই দিচ্ছেন অনুদানদাতাদের। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের একটা উদ্যোগে যদি মানুষ উপকৃত হয়, তার চেয়ে তো বড় আনন্দ আর হতে পারে না।’
তাঁদের আরও যত উদ্যোগ
মূলত ২০১১ সালে মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদে এই তিন তরুণের এক হওয়া। তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁরা খোলেন দ্বীপের খবর নামে একটি ফেসবুক পেজ। শীতবস্ত্র বিতরণ দিয়ে শুরু হয় তাঁদের কার্যক্রম। এরপর ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর আহত হয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়া সন্দ্বীপের ১৪ পোশাকশ্রমিককে অনুদান তুলে স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। সবচেয়ে বড় কাজটি সম্ভবত তাঁরা করেছেন এতিম মো. সজীবের জন্য। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম নগরের অলকার মোড় এলাকায় বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে দুই হাত হারান এই তরুণ। তাঁর জন্য প্রায় ২০ লাখ টাকার তহবিল সংগ্রহ করেন তরুণেরা। এই টাকায় চিকিৎসার পাশাপাশি তাঁর জন্য দোকান করে দেন তাঁরা। দুই বছর আগে অপহরণের শিকার শিশু জারিফকে অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় উদ্ধার করেও আলোচনায় এসেছিলেন এই তরুণেরা। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন ক্যানসারে আক্রান্ত তরুণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এখন করোনার কারণে অসহায় হয়ে পড়া মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি তাঁরা তহবিল সংগ্রহ করছেন মো. ইকবাল নামের এক ক্যানসারে আক্রান্ত তরুণের জন্য।