রামপুরার আতিকুর রহমান দ্বিধায় পড়ে গেছেন, তিনি এখন কোন ওষুধ ব্যবহার করবেন, কোনটা করবেন না। কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘করোনার শুরু থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে যখন যে ওষুধের কথা শুনেছি, তাই সংগ্রহ করে রেখেছি বাসায়। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, এজিথ্রোমাইসিন, ফেভিপিরাভির, রেমডেসিভির, আইভারমেকটিন, ডক্সিসাইক্লিন, এমনকি কানে আসতেই ছুটে গিয়ে ডেক্সামেথাসনও আনলাম। তবে সমস্যা হচ্ছে, যদি পরিবারের কেউ আক্রান্ত হয়েই পড়ে তখন এই ওষুধগুলোর মধ্যে কোনটি ব্যবহার করব?’
ধানমণ্ডির মোজাম্মেল হক আরেক ধাপ এগিয়ে ওগুলোর সঙ্গে বাসায় একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারও এনে রেখেছেন। বলেন, ‘বলা তো যায় না কখন প্রয়োজন হয়, তখন যদি না পাই!’
মিরপুর কাজীপাড়ার আলতাফ হোসেন বলেন, ‘বাসার কাছের ফার্মেসি থেকে শুনে শুনে কয়েকটি ওষুধ এনে রেখেছি। অ্যালোপ্যাথির পাশাপাশি আলোচিত হোমিওপ্যাথি— আর্সেনিকা-৩০ নামের ওষুধও এনে রেখেছি।’
বিশ্বের কোন দেশ কোন ওষুধ করোনায় ব্যবহার করছে বা কোনটি গবেষণায় সফল হচ্ছে—এমন খবর জানাজানি হলেই দেশের একশ্রেণির মানুষ যেমন ছোটাছুটি শুরু করে ফার্মেসিতে, তেমনি ওষুধ কম্পানিগুলোও এমন হিড়িক দেখে মেতে ওঠে বাণিজ্যে। রাতারাতি ওষুধ তৈরি করে বাজারজাতও করে ফেলছে করোনা চিকিৎসার নামে। ফার্মেসিগুলোতেও চলছে রমরমা বেচাকেনা।
মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের লাজ ফার্মা শাখার বিক্রয়কর্মী নাম প্রকাশ না করে সর্বশেষ আলোচনায় আসা ডেক্সামেথাসন বিষয়ে বলেন, ‘দেশের বেশ কিছু কম্পানির এই ওষুধ আমাদের কাছে আগেই ছিল। তবে হঠাৎ করে এর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমরাও বেশি করে সংগ্রহ করে রেখেছি।’ কাঁটাসুরের আরেকটি ফার্মেসির মালিক বলেন, ‘হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনে ধরা খেয়েছি। অনেক বেশি করে কিনেছিলাম। কিন্তু একপর্যায়ে এসে সেটি অচল হয়ে যায়। পরে আইভারমেকটিন নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে ওই ওষুধও বেশি করে রেখেছি। এটি এখন বেশ চলছে। তার সঙ্গে আবার কাল থেকে হঠাৎ করে চাহিদা বেড়েছে ডেক্সামেথাসন গ্রুপের ওষুধের।’
এমন পরিস্থিতি নিয়ে জনস্বাস্থ্য ও ওষুধ বিশেষজ্ঞরা এখন বড় রকমের উদ্বেগে ভুগছেন। তাঁদের মতে, ওষুধের এমন ব্যবহারে করোনার মধ্যেই আরো ভয়ানক কোনো পরিণতি যুক্ত হতে পারে। সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
ওষুধ বিশেষজ্ঞরা জানান, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ম্যালেরিয়া ও আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় ব্যবহারের ওষুধ। করোনায় ব্যবহার করতে গিয়ে দেখা গেছে, সাফল্যের চেয়ে ঝুঁকি বেশি। রেমডেসিভির ইবোলার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। করোনা চিকিৎসায় কেবল জটিল পর্যায়ের রোগীদের ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হলেও সাফল্যের হার খুবই কম।
ফেভিপিরাভির এইডসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হলেও বড় কোনো সাফল্য দেখা যাচ্ছে না। আইভারমেকটিন অ্যান্টিপ্যারাসাইটের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, এখন এটি বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে সাফল্যের ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও আইভারমেকটিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অনুমোদনপ্রাপ্ত একটি ওষুধ, যা ১৯৮০ সাল থেকে পরজীবীজনিত সংক্রমণ প্রশমনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ ছাড়া গবেষণাগারে অনেক ধরনের ভাইরাসনাশক হিসেবেও এটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ওপর প্রথম বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. তারেক আলম ওষুধটি ব্যবহারে সফলতা দেখতে পেয়েছেন বলে দাবি করেন।
সর্বশেষ ব্যাপক আলোচনায় আসা ডেক্সামেথাসন অ্যালার্জির ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখন করোনা চিকিৎসায় যুক্তরাজ্যে একটি গবেষণায় আংশিক সাফল্যের খবর প্রকাশিত হলেও এটির যথেচ্ছ ব্যবহারে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনার ওষুধের নামে ওষুধ কিনতে যেভাবে মানুষ ফার্মেসিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এতে খুবই বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। এটি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধই কেউ যাতে ফার্মেসি থেকে সংগ্রহ করতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এই বিশেষজ্ঞ উদাহরণ দিয়ে বলেন, ডেক্সামেথাসনের মতো স্টেরয়েড ওষুধ আমরা দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহার করে আসছি খুব মারাত্মক পর্যায়ের অ্যাজমা, অ্যালার্জিসহ আরো কিছু রোগের চিকিৎসায়। যখন অন্য কোনো ওষুধে কাজ করে না কেবল তখনই শেষ চেষ্টা হিসেবে স্টেরয়েড দেওয়া হয়। এর অনেক ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত কমিয়ে ফেলে, ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দেয়, উচ্চরক্তচাপ তৈরি করে, চর্মরোগ দেখা দেয়, এমন আরো কিছু সমস্যা তৈরি করে। মানুষ এগুলো না জেনে যদি এই ওষুধ নিজের মতো করে কিনে খেতে যায় তাহলে পরিণতি বিপজ্জনক ছাড়া আর কিছু নয়।
বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে এখন আরেক মহামারি চলছে, তা হচ্ছে তথ্যের মহামারি। বিশেষ করে মানুষ এখন গণমাধ্যমের দিকে খুব বেশি নজর রাখছে। কোনো মাধ্যমে বিশ্বের কোথাও ওষুধের সামান্য পরিমাণ সফলতার নাম দেখলেই কিনতে ছুটছে। ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার সময়টুকুও দেরি করে না। এর ফায়দা নিচ্ছে ওষুধ কম্পানিগুলো। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, স্টেরয়েড, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিপ্রটোজোয়ালসহ আরো কিছু ক্যাটাগরির ৬০টির বেশি জেনেরিকের পুরনো ওষুধ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা চিকিৎসায় পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চললেও কোনোটিই এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত সাফল্য দেখাতে পারছে না। ক্ষতি বেশি হওয়ায় পিছু হটেছে শুরুতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রটোকলে ৯-১০টি ওষুধের ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সবই কেবল ডাক্তারদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ওষুধ কেবলই হাসপাতালে ব্যবহার উপযোগী। এখন যদি সাধারণ মানুষ সেগুলো বাসা-বাড়িতে মজুদ করে, তাহলে কী বিপদ হতে পারে সহজেই বোঝা যায়। কারণ এই ওষুধগুলোর কোনোটিই নতুন নয় বা কেবলই করোনা চিকিৎসার জন্য নয়। এগুলো পুরনো অন্য বিভিন্ন জটিল সব রোগের ব্যবহারের জন্য। ফলে কখন কোন ওষুধ কী ডোজে ব্যবহার করতে হবে কি হবে না সেটা কেবল চিকিৎসকই বুঝবেন এবং প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে দেখবেন।
বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওভার দ্য কাউন্টার’ তালিকার বাইরে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ বেচাকেনা করা যাবে না। আর করোনার চিকিৎসায় দেশে-বিদেশে যেসব ওষুধের কথা বলা হচ্ছে তা সবটাই পরীক্ষামূলক। তাই এগুলো অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ব্যবহার না করলে বড় ক্ষতি হবে।
এদিকে কভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক বা পরজীবীনাশক ওষুধ আইভারমেকটিনের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ডক্সিসাইক্লিন, অথবা শুধু আইভারমেকটিন ব্যবহারের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে একটি পরীক্ষামূলক গবেষণা শুরু করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি)। সংস্থাটি কভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালে ভর্তি থাকা প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের নিয়ে গবেষণাটি পরিচালনা করবে। এই গবেষণায় ঢাকার চারটি হাসপাতালের ৭২ জন রোগীকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। গবেষণাটি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এবং মুগদা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে এবং অন্য হাসপাতালগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে।
আইসিডিডিআরবি সূত্র জানায়, এই গবেষণার লক্ষ্য হচ্ছে—আইভারমেকটিনের সঙ্গে ডক্সিসাইক্লিন অথবা শুধু আইভারমেকটিনের সাহায্যে চিকিৎসা দিলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমার হার এবং জ্বর ও কাশি কমতে কদিন লাগে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া। এ ছাড়া এই গবেষণা অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তার পরিবর্তন, অক্সিজেন দেওয়া সত্ত্বেও রোগী কেন ৮৮ শতাংশের বেশি অক্সিজেন স্যাচুরেশন (এসপিও২) ধরে রাখতে পারে না, রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ ও হাসপাতালে ভর্তি থাকার দিনের সংখ্যায় পরিবর্তন এবং এ রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুর কারণ জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আইসিডিডিআরবির বিবৃতিতে আন্ত্রিক এবং শ্বাস-প্রশ্বাস রোগের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং এই গবেষণার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ড. ওয়াসিফ আলী খান বলেন, ‘এই ভাইরাসের দ্রুত বিস্তারের কারণে আমাদের প্রয়োজন সার্স-সিওভি-২-এর বিরুদ্ধে কার্যকর একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ খুঁজে বের করা। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের কাছে কভিড-১৯-এর চিকিৎসা করার মতো কোনো ওষুধ নেই এবং এ ধরনের ওষুধ আবিষ্কার হতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। তাই আমাদের এমন ওষুধ খুঁজে বের করা প্রয়োজন যা বাজারে সহজলভ্য, যার ওপর যথেষ্টভাবে গবেষণা করা হয়েছে, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম এবং যা জীবন বাঁচাতে সক্ষম।
আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক জন ডি ক্লেমেন্স বলেন, নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় আইভারমেকটিন কতটা নিরাপদ ও কার্যকর তা জানার লক্ষ্যে আমাদের এই প্রচেষ্টা।