দান হলো দেয়া, বিলানো। দুনিয়ার কোনো বিনিময় ছাড়াই যে জিনিস অন্যকে নিঃস্বার্থভাবে দেয়া হয় তাকে বলা হয় দান। ঈমান, আমল ছাড়া পরকালে সম্পদ সঞ্চয়ের অন্যতম মাধ্যম হলো অসহায়ের সহায় এবং অভাবগ্রস্তের অভাব দূর করা, ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেয়া। আর এটা হয়ে থাকে দান করার মাধ্যমে। দানের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, গচ্ছিত সম্পদ হেফাজতে থাকে। বিপদ-আপদ থেকে রা পাওয়া যায়। বান্দার দান তার ওপর আল্লাহর ক্রোধকে সংবরণ করে। তাই এমনভাবে দান করা উচিত, যেন ডান হাতের দান বাম হাতেও জানতে না পারে। অর্থাৎ কাউকে দেখানোর জন্য দান করা হলে সে দান অহঙ্কারের কারণ হবে। কাজেই সে দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়।
দান করার মধ্যে রয়েছে অশেষ সওয়াবের কাজ। দুনিয়ার সমস্ত সম্পদের মালিক আল্লাহ। আল্লাহ মানুষকে সম্পদ দান করেন। অন্য অভাবী মানুষকে তা থেকে দান করলে আল্লাহ খুশি হন। দান করা একটি অতি মহৎ কাজ। মানুষের কল্যাণে নিজের অর্থ-সম্পদ ব্যয় বা প্রদান করাকে দান করা বলা হয়। দান বিভিন্ন প্রকারের হয়। সরকার তার নাগরিকদের কাছে দেশ রক্ষার্থে তথা জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে অর্থ-সম্পদ সাহায্য চাইলে জনগণ স্বেচ্ছায় তা দিলে তা হচ্ছে এক প্রকার দান। যেমন তাবুক যুদ্ধ অভিযানের প্রাক্কালে মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রধান মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আহ্বানে সাহাবিরা অকাতরে যুদ্ধ তহবিলে দান করেন। এমনকি নারীরাও গলার হার, হাতের চুড়ি, কানের দুল, আংটি ইত্যাদি যার যা ছিল তা এ তহবিলে দান করেন।প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদিতে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষকে অর্থ দিয়ে, জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করাটাও হচ্ছে একটা দান। মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি আল্লাহর ওয়াস্তে প্রতিষ্ঠা করাটাও আরেক প্রকারের দান। আর গরিবকে কেউ যদি অর্থ-সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে সাহায্য করে, তা হচ্ছে একটি অন্যতম দান। তবে দান করা বলতে মানুষ সাধারণত গরিবদের অর্থ-জিনিসপত্র দিয়ে, খাওয়া দিয়ে সাহায্য করাটাকেই বোঝে। এ দানগুলো আল্লাহর ওয়াস্তে অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মানুষের কল্যাণে দান করলে তখন একে আল্লাহর রাস্তায় দান হিসেবে গণ্য করা হয়।দান করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমাদের আমি যা দিয়েছি তা থেকে দান করো সেই দিন আসার আগে, যেদিন কোনো রকম বেচাকেনা, বন্ধুত্ব এবং সুপারিশ থাকবে না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৪)অত্র আয়াতের অর্থ হচ্ছে কোনো সামর্থ্যবান মানুষের মৃত্যু আসার আগেই তাকে মহান আল্লাহ দান করতে বলেছেন, যাতে সে গড়িমসি করে দান করতে ব্যর্থ না হয়। এর দ্বারা দান করা বিষয়টি যে কী গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা যায়!দান প্রদানে কাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘মিসকিনদের দান করলে তা শুধু একটি দান হিসেবে পরিগণিত হবে। কিন্তু গরিব নিকটাত্মীয়কে দান করলে তাতে দ্বিগুণ সওয়াব হয়। একটি দানের, অন্যটি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার।’ (তিরমিজি ও নাসাঈ)হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘দান আল্লাহর অসন্তুষ্টি লাঘব করে এবং লাঞ্ছিত মৃত্যু (খারাপ মৃত্যু বা অপমৃত্যু) প্রতিরোধ করে।’ (তিরমিজি)।দান করা সম্পর্কে হজরত মুহাম্মদ (সা.) আরো বলেছেন, ‘তোমরা দান করার ব্যাপারে তাড়াতাড়ি করবে, কেননা বিপদাপদ উহাকে (দানকে) অতিক্রম করতে পারে না।’ (মেশকাত শরিফ)। অর্থাৎ দানের দ্বারা বিপদাপদ দূরীভূত হয়। দানের দ্বারা অভাবী মানুষ অর্থ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা পায় তার দ্বারা তাদের অসহায়ত্ব কাটার পথ সুগম হয়। এটা সমাজে সুখ-শান্তি স্থাপনে ও বজায় রাখতে এবং সামাজিক পরিবেশ ভালো রাখতে সহায়তা করে।সুনির্দিষ্টভাবে এটা বলা যাবে না যে, এই জায়গায় দান সদকা করলে বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে। এটা নির্ভর করবে পরিবেশের ওপর। যদি এমন হয় যে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্য অনেক বেশি, তাহলে দান-সদকা করার সর্বপ্রথম খাত হলো এটি। আল্লাহ ফকির এবং মিসকিনের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। যাদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় বা বেঁচে থাকার জন্য যে জিনিস প্রয়োজন সেগুলোর অভাব রয়েছে, তাদেরকে সদকা করা হলো প্রথম কাজ। কখনো কখনো সেই প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে পারে। যেমন, বড় ধরনের বন্যা হয়েছে বা বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, মানুষ আবাসহীন হয়ে গিয়েছে, তখন এইখানে দান সদকা করাটাই উত্তম।কেউ যদি অতিরিক্ত দান করতে চান তবে ফকির মিসকিনদের দান করবেন। দানের মধ্যে আরেকটি উত্তম দান হচ্ছে সদকায়ে জারিয়া করা। সব সদকা কিন্তু সদকায়ে জারিয়া নয়। সদকায়ে জারিয়া হলো ওই সদকা যেটা সবসময় অব্যাহত থাকবে। যেমন, মসজিদ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করা, টিউবওয়েল স্থাপন করা ইত্যদি সেটা আপনি মারা যাবার পরও অব্যাহত থাকবে এবং মানুষ সেখান থেকে উপকৃত হতে পারবে। আরেকটি উত্তম সদকার কথা রাসুল (সা.) বলেছেন, সেটা হলো আপনার প্রয়োজন থাকা শর্তেও আপনি নিজে ত্যাগ করে দান করবেন, আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করবেন, সদকা করবেন, এই সদকা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সদকা।এ ছাড়া দানের দ্বারা স্থাপিত স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, হাসপাতাল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান জনগণের তথা দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতেও অবদান রাখে। এতে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব হতে থাকে। সর্বোপরি দানের দ্বারা শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই উপকৃত হয় না, এর দ্বারা সমাজ ও দেশ উপকৃত হয়।সমাজের প্রতিটি অধ্যায়ে অনাথ-অভাবীদের প্রতি বিশেষ গুরুত্বদান অত্যাবশ্যক। এটাই রাসূলের শিক্ষা। কাজেই প্রকৃত অসহায়-অভাবীদের প্রতি কুরআন-হাদিসে দানের নির্দেশনা অনুযায়ী দানের হাত সম্প্রসারণ করার মধ্যে রয়েছে সফলতা। দুনিয়ার এ অর্থসম্পদ ব্যয় হোক সঠিক পথে, সঠিক উপায়ে। সবার মধ্যে তৈরি হোক অন্যের প্রতি সহানুভূতির দৃষ্টিভঙ্গি।
লেখকঃ সম্পাদক ডেইলি বিডি নিউজ ডট নেট